একটি অসমাপ্ত প্রেমের গল্প (ইরোটি২৪)
এক
পারমিতা ক্লাস শেষে ঘরে ফিরছিল । প্রচন্ড গরম
পড়ছে আজ । পোড়া রোদে গায়ের চামড়া যেন
ঝলসে যাওয়ার উপক্রম । দুপুর গড়িয়ে যায় যায় ।
প্রতিদিন তাও একটু আগে আগে বাড়ি ফেরা যায় ।
কিন্তু আজ শনিবার । শনিবার আর রবিবার এ দু’টো দিন
অনেকগুলো স্যারের ক্লাস থাকে । ক্লাস শেষ
হতে হতে দুপুর গড়ায় । এমনিতে শরীরটা ভাল
লাগছিল না দেখে সকালে তেমন কিছু মুখে দিয়ে
আসে নি পারমিতা । এখন ক্ষিদের জ্বালায় পেটটা
চোঁ চোঁ করছে । ক্যাম্পাস থেকে বেরুতে
বেরুতে পার্সটা চেক করল । তেতাল্লিশ টাকা কাঁটায়
কাঁটায় । ফার্মগেট যাওয়ার রিক্সা ভাড়া ত্রিশ , বাকীটা বাস
ভাড়া । কিছু কিনে খাওয়ারও উপায় নেই । একসময় দরাদরি
করে পঁচিশ টাকায় যাওয়া যেত । কিন্তু আজকাল সাত
রাস্তার মোড় পার হতেই যা জ্যাম পড়ে রিক্সাওয়ালা
মামারা ত্রিশ টাকার কমে যাবেই না । এতগুলো টাকা
দিয়ে রিক্সায় চেপেও শান্তি নেই । কখনো
কখনো জ্যামের মধ্যে বসে থাকতে হয়
ঘণ্টাখানেক । আর এই কাঠফাটা রোদে তো কথাই
নেই । রিক্সার হুড টেনে দিয়েও পোড়া
রোদের ঝাঁঝ থেকে বাঁচার উপায় নেই । ভার্সিটি
গেইটে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল । যদি কোন
পরিচিত মেয়েকে পাওয়া যায় তাহলে শেয়ারে যাওয়া
যাবে । কিন্তু এ মুহূর্তে কাউকে দেখা যাচ্ছে না ।
ওর কপালটাই যেমন । ওদের সেকশনে ওসহ মাত্র
চারটে মেয়ে । ওদের কারো সাথে খুব একটা
থাতির নেই পারমিতার । ওরা সব উচ্চবিত্ত পরিবারের
সন্তান । মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে বলে ওরা
ওকে খুব একটা ভাল নজরে দেখে না । যদিও
আজকাল মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির ভুড়ি ভুড়ি
ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট ইউনির্ভাসিটিতে পড়ে
তাও মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির একটা মেয়ে প্রাইভেট
ভার্সিটিতে পড়া ওদের চোখে গরীবের ঘোড়া
রোগ । তার উপরে চারজনের মধ্যে পারমিতাই
দেখতে সুশ্রী । সুশ্রী বলতে শুধু সুন্দরী না ,
সুনয়নাও । ওর চোখের দিকে একবার তাকালেই
যে কারো দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছে করবে ।
অতএব সর্বশেষ বিবেচনায় ওকে তো পাত্তা
দেয়া সম্ভব না ঐ তিনজনের । পারমিতাও আর ওদের
সাথে গায়ে পড়ে ভাব জমাতে যায় না ।
ক্ষিদের জ্বালায় আর রোদের তাপে আর একটুও
অপেক্ষা করা সম্ভব নয় । রিক্সা একটা ডেকে
ওঠে পড়ল । উঠতেই চোখ পড়ল প্রতিদিনের
উটকো ব্যাপারটা । ওর রিক্সার আর একটু সামনের
রিক্সাটায় চাপল প্রতিদিনের মত চশমা পড়া সাদাসিধে
ধরণের ছেলেটা । ওর রিক্সাটা ছেলেটার রিক্সা
টাকে অতিক্রম করে গেলেই ঐ রিক্সার মামা
প্যাডেলে পা রাখেন । এটা হয়ত ছেলেটাই
রিক্সাওয়ালাকে বলে রাখে । উহ্ , আরেক অসহ্য
ব্যাপার ! পারমিতা প্রথম প্রথম ব্যাপারটা খেয়ালই করত
না । কিন্তু তা যখন চিরায়িত সত্যের মত রোজ রোজ
ঘটতে থাকল তখন তা পারমিতার নজরে আসল । আর
সেটা এখানেই শেষ না । প্রতিদিনই ওর রিক্সার
পেছন পেছন ফার্মগেট গিয়েই ছেলেটা ক্ষান্ত
হয় না । ফার্মগেট থেকে পারমিতা যখন যে বাসে
উঠে সেও পিছু পিছু ঠিক একই বাসে উঠে । পারমিতা
বাসের সামনের দিকে মহিলা সিটের ওখানে দাঁড়াত
(বেশির ভাগ সময় দুপুরের দিকে সিট খালি থাকে না) ।
আর ছেলেটা উঠে ঠেলাঠেলি করে বাসের
ভিতরের দিকে লোকারণ্যে মিশে যেত ।
পারমিতার ধারে কাছে ঘেষত না । অদ্ভুদ কাণ্ড !
আরও অদ্ভুদ কাণ্ডটা পারমিতার অনেক পড়ে
চোখে পড়েছিল । সেটা হল পারমিতা দেখত
ছেলেটা ওর সাথে সাথে পল্লবীতে নেমে
পড়ত । ও প্রথম প্রথম ভাবত ছেলেটার বাসা হয়ত
এদিকে কোথাও । পরে একদিন সে তড়িঘড়ি করে
নেমে দোকানপাটের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে
লাগল ছেলেটা কি করে । পারমিতা অবাক হয়ে
দেখল ছেলেটা অনেকক্ষণ ওকে খোঁজাখুঁজি
করে না দেখে রাস্তা পার হয়ে উল্টো দিকে
বাসে উঠে পড়ল । ওর বুঝতে বাকী থাকল না
ছেলেটার বাসা আশেপাশে কোথাও না । সে যাই
হোক , ছেলেটার এই অদ্ভুদ আচরণে পারমিতা
কিছুটা বিরক্ত হলেও ছেলেটাকে খারাপ বলে
মনে হয় না ওর । কারণ ছেলেটা রিক্সায় , বাসে কিংবা
বাসস্টপে ওর দিকে সবসময় তাকিয়ে থাকলেও ও
যখন ছেলেটার দিকে তাকায় তখন সে সঙ্গে
সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলে কিংবা অপ্রস্তুতভাবে
এদিক ওদিক তাকাতে থাকে । এমন অদ্ভুদ উন্মাদ সে
আগে কখনো দেখেনি ।
রিক্সা থেকে নেমে গাদা গাদা মানুষের ভীড়ে
প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দাঁড়াতে বাধ্য পারমিতা । কিছুই
করার নেই , বাসায় তো ফিরতে হবে । প্রচণ্ড
গরমে আর ক্ষিদের জ্বালায় ছেলেটার কথা ভুলে
গেল পারমিতা । ছেলেটা ওর থেকে একটু দূরে
দাঁড়িয়ে ছিল । বাসের জন্য অপেক্ষা করতে
করতে ওর চোখ গেল রাস্তার মোড়ে
শরবতের ভ্যানে । লেবুর রস চেপে নিয়ে
সাথে মধু আর বরফ কুচি দিয়ে একটা গ্লাসের উপর
আর একটা চেপে ধরে নিপুণ ভঙ্গিতে ঝাঁকিয়ে
গ্লাসের পর গ্লাস শরবত বানিয় যাচ্ছে বিক্রেতা মামাটা
। ভীড় লেগেই আছে । পথচারী সবাই কিনে
খাচ্ছে । এই কাঠফাটা রোদে পারমিতা আত্মসংবরণ
করতে পারল না । জিভে পানি চলে এল । ইচ্ছে
করল দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস কিনে খায় । কিন্তু বাস
ভাড়াটাই আছে শুধু ।অবশ্য টাকা থাকলেও অত ধরণের
মানুষের মধ্যে গিয়ে একটা মেয়ের শরবত
কিনে
খাওয়ার ব্যাপারটা কেমন জানি দেখায় ।
আঙ্গুর ফল
টক- পারমিতা নিজেকে বুঝাল ।এমন সময়
হঠাত্
ছেলেটার দিকে চোখ পড়ল ওর ।ছেলেটা ওর
দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল । রোদে
পুড়ে
মুখটা লালচে দেখাচ্ছিল । ও তাকাতেই
ছেলেটা মাথা
নিচু করে অন্যদিকে তাকাল । পারমিতা
কিছুক্ষণ তাকিয়ে
রইল ছেলেটার দিকে ।তারপর হঠাত্ কি
মাথায় এলো
ছেলেটাকে ডাক দিল , 'এই যে শুনুন' ।
ছেলেটা
অপ্রস্তুত হয়ে পেছন দিকে তাকালো কেউ
আছে কিনা দেখতে । কাউকে না দেখে
আরো
বেশি অপ্রস্তুত হয়ে গেল । আমতা আমতা করে
বলল , 'জ্বি ? আমাকে বলেছেন ?' 'জ্বী
আপনাকে' ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিল
পারমিতা ।
‘একটু এদিকে আসুন ’। ছেলেটা ভীরু ভীরু
পায়ে এগিয়ে এল । 'আচ্ছা আপনি কি
আহসানউল্লাহ্
তে পড়েন ?' 'জ্বি' 'কোন্ সাবজেক্ট ?' 'জ্বী
সিএসই' । 'কোন্ সেমিস্টারে ?' 'টু-টু' । 'টু-টু ?
আপনি
কি জানেন আমি কোন্ সেমিস্টারে ? আমি
বিবিএ
ফোর-ওয়ান । আমি তোমার সিনিয়র' । 'জ্বি
জানি' ।
'জানো ? তাহলে তোমার সমস্যাটা কি ?'
'জ্বী
মানে-' 'তোমার কি চোখে সমস্যা ?' 'ইয়ে-
মানে-'
'এত ইয়ে মানে করছো কেন ?' 'জ্বী
আসলে-' 'শোন আমি ঐ যে ঐ পাশটাতে গিয়ে
দাঁড়ালাম । আমার জন্য এক গ্লাস শবরত নিয়ে
আসো'
। 'জ্বী মানে ?' 'তুমি কি আমার কথা বুঝতে
পারছো
না ? আমার বড্ড তেষ্টা পেয়েছে' । 'জ্বী
আনছি' । 'শোন । দুই গ্লাস এনো । তোমার
গলাটাও
শুকিয়ে গেছে মনে হয়' । 'জ্বী আচ্ছা' ।
পারমিতা রাস্তার একটু সাইডে গিয়ে দাঁড়াল
। ছেলেটা
বাধ্য বালকের মত দু গ্লাস শরবত নিয়ে ওর
দিকে
এগিয়ে এল । আস্তে আস্তে কাঁপা কাঁপা
হাতে একটা
গ্লাস বাড়িয়ে দিল । ছেলেটার অবস্থা
দেখে
পারমিতার খুব মায়া হল । গ্লাসটা নিয়ে এক
চুমুকে শেষ
করে ফেলল সে । ' কি ? তুমি খাবে না ? অমন
করে কি দেখছো ? ' ' ইয়ে মানে- এইতো
খাচ্ছি
' বলে সেও শরবত শেষ করল । শেষ করে
পারমিতার দিকে এমনভাবে বাধ্য ছাত্রের
মত তাকাল
ভাবটা এমন যেন- এখন কি করতে হবে
ম্যাডাম । ' কি
হল ? অমন বুদ্ধুর মত তাকিয়ে আছো কেন ,
গ্লাস
দুটো দিয়ে এসো ' । ' জ্বী ' বলে গ্লাস দুটো
নিয়ে ছেলেটা চলে গেল । শরবতের দাম
মিটিয়ে
দিয়ে ফিরে এলো সে । ' তুমি তাহলে ভাল
করেই
জান আমি তোমার সিনিয়র ' । ' জ্বী ' ' তাহলে
তুমি যা
করছো এটাকে কি বলে ? আমার তো মনে হয়
পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না ! ' ' জ্বী ' ' এত
জ্বী
জ্বী করছো কেন ? ' বিরক্তিতে ঠোঁট
বাঁকালো পারমিতা । অনেকক্ষণ চুপ করে
থাকার পর
বলল, ' শোন । কাল থেকে এভাবে আর আমার
পিছু
পিছু ঘুরবা না । ঠিক আছে ? ' ছেলেটার চোখ
ছলছল করছিল । পারমিতা পুরোপুরি বিব্রত
হয়ে গেল
। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারল না । এভাবে
অনেকক্ষণ কেটে গেল । ' কি হলো ? চুপ
করে আছো কেন ? কি বলছি বুঝেছো ? ' '
জ্বী আচ্ছা '। একটা বাস এসে দাঁড়াতেই
পারমিতা
এগিয়ে গেল । ছেলেটি যেখানে ছিল
সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল । বাসে উঠে আজও
সিট
পেল না । মহিলা সিটের কাছাকাছি দাঁড়াল
সে । বাস
ছেড়ে গেল । এত মানুষের ভীড় উপেক্ষা
করে জানালা দিয়ে উঁকি দিল পারমিতা ।
যতক্ষণ দেখা
গেল ছেলেটা ঐখানেই দাঁড়িয়ে ছিল ।
পারমিতার
কেন জানি অসম্ভব মায়া হচ্ছিল ছেলেটার
জন্য ।
এমন পাগলামো কেউ করে । অদ্ভুদ ছেলেটা !
তবে সবচেয়ে বেশি অদ্ভুদ নিজেকেই
ঠেকছিল পারমিতার । অচেনা অজানা একটা
ছেলের
জন্য ওর এত মায়া হচ্ছে কেন ? আর্শ্চয !
পরদিন আবার বাসায় ফেরার পথে
ছেলেটাকে
ডেকে পারমিতা জিজ্ঞেস করল , ' শরবতের
দাম
কত ছিল ? জ্বী কেন ? ' ' বলছি শরবতের দাম
কত
ছিল ? ' ' জ্বী পাঁচ টাকা ' । পারমিতাকে
পার্সে হাত
দিতে দেখে ছেলেটার চোখ গতকালের মত
ছলছল করে উঠল । ' টাকাটা ফেরত দেওয়া খুব
কি
আবশ্যিক ? ' ' হুম । মন খারাপ করো না । আমি
তোমার সিনিয়র । নাও দশ টাকা । মনে করো
গতকাল
আমি তোমাকে খাইয়েছি । ওকে ? আল্লাহ্
হাফেজ ' ।
দুই
সচারাচর কোন কিছু নিয়মিত ঘটতে থাকলে
যতই
বিরক্তির বা অপছন্দের হোক না কেন , তা
যদি হঠাত্
বন্ধ হয়ে যায় বা আর চোখে না পড়ে তখন
মানুষ
অচেতন মনেই তার অভাববোধ করে । আস্তে
আস্তে দিন যেতে লাগল । প্রতিদিন বাসায়
ফেরার
পথে ভার্সিটি গেইটে , রিক্সা স্টপে , বাস
স্টপে
প্রায় সব জায়গায় পারমিতা এদিক ওদিক
উঁকি দিয়ে সেই
অদ্ভুদ ছেলেটিকে খোঁজে । কিন্তু তাকে আর
আগের মত দেখতে পাওয়া যায় না । পারমিতা
রোজ
ছেলেটার কথা ভাবে । নিজেকে নিজের
বিশ্বাস
হয় না ওর । ও এমন পাগলামো করছে কেন ! ও
কি
তবে ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলেছে ?
ছি ছি ! এ কি করে সম্ভব ? ছেলেটা যে
বয়সে
ওর ছোট । বয়সে ছোট একটা ছেলেকে
ভালোবাসা যায় ? আচ্ছা , ভালোবাসা কি
বয়স দেখে
হয় ? ভালোবাসা কি বলে কয়ে আসে মানুষের
জীবনে ? এমন অজস্র চিন্তা পারমিতার
মাথায় ঘুরপাক
খায় সবসময় । নিজেকে ভালোবাসার
নির্দিষ্ট কোন
তত্ত্বে দাঁড় করাতে না পারলেও পারমিতা
এটা বুঝতে
পারে যে ও সর্বক্ষণ ছেলেটার অভাব অনুভব
করে ।
দেখতে দেখতে পারমিতার অনার্স শেষ হয়ে
গেলো । গতকাল ছিল ওদের শেষ পরীক্ষা ।
ডিপার্টমেন্টের কিছু অফিসিয়াল কাজ ছিল
পারমিতার ।
দিনটা ছিল মেঘলা মেঘলা । পারমিতা একটু
বেলা করেই
বাসা থেকে বেরিয়েছিল । রিক্সা থেকে
নেমে
সোজা রেজিস্টার অফিসে চলে গেল ও।
কাজগুলো শেষ হতেই তড়িগড়ি করে অফিস রুম
থেকে বেরিয়ে পড়ল । বেরিয়ে সিএসই
ডিপার্টমেন্টের দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগল ।
পারমিতা
গতকাল জেনে নিয়েছিল আজই সিএসই থ্রি-
ওয়ানের
শেষ পরীক্ষা । পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র
কিছুক্ষণ আগে । পরীক্ষা দিয়ে সবাই এক এক
জায়গায় যে যার মত জড়ো হয়ে কথা বলছিল ।
এত
ছেলে মেয়ের ভীড়ে ছেলেটাকে খুঁজতে
গিয়ে বড় সমস্যায় পড়ল । কাউকে জিজ্ঞেস
করারও
উপায় নেই । ছেলেটার নাম পর্যন্ত জানা
হয়নি । নামটা
জানলে অন্তত সবার কাছ থেকে খোঁজ নেয়া
যেত । পারমিতা কি যে করবে বুঝতে
পারছিল না ।
হঠাত্ এমন সময় চোখ পড়ল ছেলেটার উপর ।
বারান্দার এক পাশে রেলিং-এ হাত দিয়ে
কুঁজো হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা । পারমিতা এগিয়ে
গেল , '
শোন ' । পেছন ফিরে তাকাতেই অবাক হল
ছেলেটা । পারমিতা কাছে এসে দাঁড়াল । ওর
বিষণ্ন
চোখ দুটোর পানে বেশিক্ষণ থাকিয়ে
থাকতে
পারল না । চোখ সরিয়ে নিল । ছেলেটা
স্মিতহাস্যে
বলল , ' কেমন আছেন ? ' ছেলেটার বিষাদভরা
মুখের শুকনো হাসিটা পারমিতার ভেতরটা
ভেঙ্গে
খান খান করে দিল । নিজেকে সামলে নিয়ে
বলল ,
' তোমার কয়েকটা মুর্হূত আমি পেতে পারি ? '
'
জ্বী বুঝলাম না ? ' কিছুটা বিস্ময়ে
জিজ্ঞেস করল
ছেলেটা । ' আমার সঙ্গে চল ' । ' কোথায় ? ' '
চলই না, বলছি...' ' আচ্ছা চলুন ' । দুজনে
একসাথে
হাঁটতে শুরু করল । পারমিতা বিস্ময়ের সাথে
লক্ষ্য
করল ছেলেটা হঠাত্ কেমন জানি পরিণত হয়ে
গেছে । ওর আগের সেই অপ্রস্তুত ভঙ্গি ,
কথাবার্তা কিছুই নেই । সবকিছু এখন বড়ই
সাবলীল ।
ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে দুজনে রিক্সায়
চাপল ।
রিক্সায় চুপচাপ বসে রইল দুজনে । কারো মুখে
কোন কথা নেই । ফার্মগেট নেমে পারমিতা
আরেকটা রিক্সা ডাকল , ' মামা ধানমন্ডি ৮
নম্বর
যাবেন ? রবীন্দ্র সরোবর ? ' ছেলেটা
কৌতুহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল , ' ঐখানে
কেন ?' পারমিতা ভাবলেশহীনভাবে উত্তর
দিল , '
ঘুরতে '। দুজনে আবার রিক্সায় উঠে পড়ল ।
এবারও
কারো মুখে কোন কথা নেই । রিক্সা থেকে
নেমে ধীর পায়ে লেকের দিকে এগিয়ে
গেল দুজনে । দীর্ঘক্ষণের নীরবতা
ভেঙ্গে পারমিতা বলল , ' শোন আজকে যতক্ষণ
তোমার সাথে আছি এভাবে মনমরা হয়ে
থাকার
ইচ্ছে নেই আমার ' । ' তো আপনার জন্য কি
করতে পারি বলুন ?' ' কি করবা মানে ? একটু
হাসতেও
কি পারো না ? মনে হয় অনেকদিন তুমি হাস
না ' ।
পারমিতার কথাটা শুনে এক চিলতে হাসি
ফুটে উঠল
ছেলেটার মুখে । ' বাহ্ ! তোমার হাসি তো
অনেক সুন্দর ' বলতেই দুজনে হো হো করে
হেসে উঠল । ' ঐদিকে দেখো । ডিঙ্গি ! চল
বোটে চড়ব । প্যাডাল বোট চালাতে পার ? '
'পারব
হয়ত ' । ' চল যে আগে পৌঁছাতে পারে '।
'মানে ? '
' কোন মানে নেই ' বলেই পারমিতা স্যান্ডেল
হাতে নিয়ে বাচ্চাদের মত দিল ছুট । কে কি
ভাববে
তোয়াক্কা করল না । ছেলেটা প্রথমে কিছু
বুঝে
উঠতে পারল না । পরে পারমিতাকে অনুসরণ
করে
সেও ছুটতে লাগল । ডিঙ্গি'র কাছে পৌঁছে
দুজনে
হাঁপাতে হাঁপাতে হাসতে লাগল । হাসতে
হাসতে
দুজনের পেটে খিল ধরে গেল । ছেলেটা
বলল , ' হঠাত্ এমন ছেলেমানুষী । বুড়ি হয়ে
গেছেন । সবাই কি ভাববে বলুন তো ?' বলে
আবারও হাসতে লাগল । ' বলুক গে । আমি
কারো ধার
ধারি না । চল বোটে উঠি । সকাল থেকে
মেঘলা ।
ইশ ! বৃষ্টি নামলে ভালো হতো ! যাও টিকিট
কেটে
এসো । '
দুজনে বোটে উঠল । ছেলেটা অনেক্ষণ
ধরে চেষ্টা করেও বোট সামনে নিতে
পারছিল না
। প্যাডেল বোটে সে আগে কখনো চড়েনি ।
বোটটা এক জায়গাতেই ঘুরপাক খেতে লাগল ।
ওর
চালানোর অপটুতা দেখে পারমিতা হেসে খুন
। ওর
হাসি যেন থামতেই চায় না । অনেক্ষণ
চেষ্টার পর
কোনরকমে বোটটা লেকের মাঝামাঝিতে
নিয়ে
আসল । ' অমন করে কি দেখছো ?' ' আপনার
হাসি '
। ' কেন ? ' ' হাসি কি অমন করে দেখার মত
জিনিস
হলো ?' ' ঠিক তা না । আসলে আর কখনো
দেখতে পাই না পাই তাই মন ভরে দেখে
নিচ্ছি '।
মুহূর্তেই পারমিতার মুখের হাসি উবে গেল ।
শূন্য
দৃষ্টিতে লেকের জলে চেয়ে রইল । এভাবে
চুপচাপ কেটে গেল অনেকক্ষণ । ' তুমি কি
জানতে চাও না আমি কেন তোমায় সঙ্গে
করে
এখানে এসেছি ?' ' কেন ?' ‘কাল আমাদের
অনার্স
লাস্ট এক্সাম ছিল । আজকের পর হয়ত তোমার
সাথে আর কখনও দেখা হবে না '। ' কেন ?
এমবিএ
করবেন না ?' 'না । বাবা আমার বিয়ে ঠিক
করেছেন ।
সামনের মাসেই বিয়ে ' । ছেলেটা বিষণ্ন
চোখে
তাকিয়ে রইল । ' কি মন খারাপ হয়ে গেল ?'
'ঠিক মন
খারাপ না আসলে । নতুন করে মন খারাপ
করারও কিছু
নেই ' । 'দেখো বোঝার মত তোমার যথেষ্ট
বয়স হয়েছে । তুমি যা চাইছো তা কখখনো
সম্ভব
নয় '। 'হয়ত বুঝি দেখেই আজ পর্যন্ত আপনার
মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াই নি কখনো । আচ্ছা
আপনি
বললেন , তুমি যা চাইছো- একটা কথা খুব
জানতে
ইচ্ছে করছে ' । ' কি ?' 'আপনি কি বিয়েটাতে
রাজি ?'
'দেখো সবাই সবকিছু চাইলেও পায় না ।
আবার সবার
সবকিছু চাইতেও নেই ' । 'কেন ?' ' কেনর উত্তর
বলব বলেই তোমাকে এখানে এনেছি । আমরা
তিন
বোন , তিনজনের মধ্যে আমি মেঝ । আমি যখন
সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হই তখন বড় আপুর
বিয়ে
ঠিক হয় । এমনসময় হঠাত্ একদিন বড় আপু ওর
ইউনিভার্সিটির একটা ছেলের সাথে
পালিয়ে যায় । মা-
বাবা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল । মা তো এ কষ্ট
নিয়ে বেশিদিন থাকতেই পারল না ।আপু চলে
যাওয়ার
পরপরই মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন । এর
মাসখানেকের ভেতর মারা যান । আর বাবা
হয়ে যান
শোকে পাথর । এরপর থেকে বাবা কারো
সাথে
ভাল করে কথা বলেন না । একদম চুপচাপ হয়ে
গেলেন । এমন কি আমাদের সাথেও
প্রয়োজনের বেশি দু'দন্ড কথাও বলেন না ।
আজ
প্রায় ছয় বছর হতে চলল । আমি নিজের চোখে
দেখেছি মা-বাবা কি কষ্টটাই না পেয়েছেন
।
এখনো মাঝে মাঝে মায়ের ছবি বের করে
বাবাকে লুকিয়ে কাঁদতে দেখি । আপুর এ
ঘটনার পর
থেকে আমি মনে মনে শপথ করেছিলাম এ
জীবনে কখনো কারো প্রেমে পড়ব না ।
কাউকে ভালোবাসব না । ভালোবাসা আমার
জন্য
আসেনি । আমি নিজে কাঁদতে রাজি আছি ,
তবুও
বাবাকে আবার নতুন করে কাঁদাতে পারব না '
বলতে
বলতে পারমিতার দুচোখ ভরে লোনা পানির
ঢল
নেমে এলো । হঠাত্ করেই বৃষ্টি আরম্ভ হল ।
স্থির লেকের জলে বোটে বসে দুজনে
চুপচাপ ভিজতে লাগল । পারমিতার চোখের
জল বৃষ্টির
জলে মিশে একাকার হয়ে গেল । এভাবে
তারা
কতক্ষণ ছিল নিজেরাই জানে না । একপশলা
বৃষ্টি
হয়েই থেমে গেল । চারপাশের প্রকৃতিটা
হঠাত্
করেই শান্ত হয়ে গেল । ঘোর কাটতেই
পারমিতা
আর্দ্র কণ্ঠে বলল , ' চল যাওয়া যাক ।
অনেকক্ষণ
হল' । ছেলেটা বলল , 'যদি কিছু মনে না করেন
আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি ?' ' হাত ধরে
আর কি
হবে ? আজ আমি তোমার থেকে কিছু মুর্হূত
চেয়ে নিয়েছিলাম আমার কিছু মুর্হূত তোমায়
দেব
বলে । এর চেয়ে বেশি কিছু দিয়ে আর কষ্ট
বাড়াতে চাই না ' । ছেলেটি চুপ করে রইল ,
আর কিছু
বলল না ।
বোট থেকে নেমে দুজনে আস্তে আস্তে
হাঁটতে লাগল । ' শোন । ভাল করে লেখাপড়া
করে
প্রতিষ্ঠিত হও । তারপর লাল টুকটুকে দেখে
একটা
বউ আনবে ঘরে । কেমন ?' ' আচ্ছা ।' ছেলেটা
হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করল । ' শোন জীবন
কারো
জন্য থেমে থাকে না । সবাই সবকিছু পায় না ।
ভালো
সবাই বাসে । কিন্তু সবার ভালোবাসা পূর্ণতা
পায় না ।
আর ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার
যন্ত্রণা বলে
যদি কিছুই না থাকতো তবে মানুষ
ভালোবাসা পেয়ে
সুখী হতো না কখনো । জানো , আমি আজ
অনেক সুখী । জানি না অদূর ভবিষ্যতে আমার
জীবনে যে আসছে তার কাছ থেকে কতটুকু
ভালোবাসা পাব । তবে আমি এটা জানি ,
আমি একজন
মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি । তার দেয়া
কিছু মুর্হূত
পেয়েছি । এখন সেই মুর্হূতগুলোকে অবলম্বন
করে আমি সামনে এগিয়ে যাবো । পারলে
তুমিও
তাই করো ' । ' হুম ।' 'একটা রিক্সা ডাকো তো
'।
রিক্সায় উঠতে গিয়ে আবার পেছন ফিরে
তাকাল
পারমিতা । ' ভাল কথা আজ পর্যন্ত তোমার
নামটাই জানা
হল না । কি নাম তোমার ?' একটা ম্লান হাসি
খেলে
গেল ছেলেটার মুখে , 'কি হবে আর নাম
জেনে ?' 'তাও ঠিক । কি হবে আর নাম
জেনে !
নাইবা জানলাম....' ফোঁস করে একটা
দীর্ঘশ্বাস
গোপন করার চেষ্টা করল পারমিতা । ' চলি
তবে ,
ভালো থেকো ।' রিক্সায় উঠে হুড টেনে দিল ।
ধীরে ধীরে রিক্সা চলতে শুরু করল ।
পারমিতার
দুচোখ বেয়ে আবারও ঢল নামতে শুরু করল , এ
যেন ফুরাবার জন্য নয় । রিক্সা চলছে তো
চলছে ,
পারমিতা কাঁদছে তো কাঁদছে ।
সেদিন সন্ধ্যা বেলা (গল্প)
ReplyDeleteVisit More Information