একটি নারীর কণ্ঠস্বর!
বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি" বাক্যটি স্বাভাবিকভাবেই বললাম আপুকে।আপু এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন এইমাত্র সে ভয়ানক কোনো খবর শুনেছে। আপু বলল-
-পালিয়ে এসেছিস মানে!family কে কিছু না জানিয়েই চলে এসেছিস?
-হ্যা।আমি আর ওই বাড়িতে যাবো না।
-কেন এইরকম পাগলামি করছিস মাহি?
-পাগলামি করছি না।তুই জানিস যে আমি এখন বিয়ে করতে রাজি না।কিন্তু এরপরও বিয়েটা আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।যেই লোকটিকে আমার জন্য ঠিক করা হয়েছে তাকেও আমার পছন্দ হয় নি।বুড়া টাইপ লোক।এই লোক কতো টাকার মালিক তা আমার দেখার বিষয় না।আমি এখন বিয়ে করবো না।ব্যস..তুই আমার জায়গায় থাকলে এই একই কারনে তুইও বাড়ি ছেড়ে চলে আসতি।
-তোর BCS এর সপ্ন??
-মা কে বলেছিলাম।আমার খুব ইচ্ছে ছিল HSC পরীক্ষার পরই আমি অনার্স ভর্তি হবো।কিন্তু কিছুই হলো না।মা শুনলো না,কেউ শুনলো না।উলটো বিয়ে শব্দটার মাঝখানে এন্ট্রি হয়ে গেলো।
আমি যে খালি হাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে এখানে (Dhaka) এসেছি তাও কিন্তু না।আমার কাছে আছে চার হাজার টাকা,একটি মোবাইল,কিছু কাপড়,জিপিএ-4.80 পাওয়া H S C মার্কশীট।কাজেই সময় গড়িয়ে দুই দিন কাটলো।হয়তো লুকিয়ে থাকা সমাধান না।আর এইভাবে আরেকজনের ঘাড়ে চেপে বসে থাকবো আর কতোদিন!বিষয়টা আমাকে খুব বেশী ভাবিয়ে তুলছিল।বাড়ি থেকে আমার পালানোর বিষয়টা এতোদিনে আশেপাশে ছড়িয়ে পরেছে নিশ্চয়ই।হঠাৎ একদিন আমার ফ্রেন্ড(যার আশায় আমার পালিয়ে আসা) কল দিলো-
-হ্যালো, মাহি তুমি কোথায়?যা শুনলাম তা কি সত্যি!
-হ্যা,সবই সত্যি।আমি আপুর কাছে আছি।আপাতত এইখানে লুকিয়ে আছি।
-আর কতোদিন এইভাবে লুকিয়ে থাকবে?
-জানি না।বুঝতে পারছি না কি করা উচিত আমার।
-জব করবা?তুমি বললে আমি কাজ ম্যানেজ করে দিতে পারবো।
-কেমন কাজ?
-লোকাল ক্লিনিকে ভালো জব দিতে পারবো।তিন হাজার টাকা সেলারি আসবে।
-আমি করবো এই জব।কিভাবে কি করতে হবে আমাকে?
-তুমি আমাদের বাসায় এসে পর।বাকিটুকু আমি দেখছি।
আমি রাজি হলাম।এই মুহূর্তে এই একটা পথ-ই আমার চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছিলো।আমি সেই বন্ধুর বাসায় থাকতে লাগলাম।তিন হাজার সেলারির জব নিলাম।নিজের খরচ নিজেই চালালাম।শুধু আশ্রয় হিসেবে রয়ে গেলাম friend এর বাড়িতে।
টাকা জমিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হলাম।যেইটা ছিল আমার পছন্দের সাবজেক্ট।কিন্তু তিন হাজারে কলেজের খরচ,আসা-যাওয়ার ভাড়া সব মিলিয়ে ম্যানেজ করা খুব কঠিন ছিল।টিফিন খেতাম হাল্কা খাবার কেননা ভারী খাবার কিনতে টাকা বেশী লাগবে।দশ টাকা বাস ভাড়ার চেয়ে পায়ে হাটা পথটাকেই আমাকে আপন করে নিতে হলো।
জীবনের যেই মুহূর্তটায় মানুষ তার পরিবারের সাথে সুখে বসবাস করে আর আমি সেই সময়টায় লড়ছি নিজের জন্য।সবারই জীবনে এইরকম একটা সময় আসে যেই সময়টায় মানুষকে তার সাহসিকতার ভূমিকা পালন করতে হয়।হয়তো আমার জীবনেও সেই সময়টাই এখন যাচ্ছে।
সময় এইভাবেই যেতে লাগলো।এক বছর,দুই বছর,..
আমার একজন টিচার যিনি বাংলাদেশের একজন নাম করা ডিরেক্টর এবং স্ক্রিপ্ট রাইটার।যিনি কয়েকজনকে তাদের স্টুডিওতে কাজ দিলেন।ওদের মধ্যে আমিও একজন।কাজ আমার পছন্দ হলো।ভিডিও এডিটিং এর কাজ।মাসিক সেলারি সাত হাজার।আমি কাজ করতে থাকলাম বেশ আনন্দ নিয়ে।নিজের দক্ষতাকে কাজের মাধ্যমে পরিচয় দিলাম।অবশেষে দশ হাজার টাকায় আমার জব হলো আরেকটি।কিন্তু একজন মেয়ের জন্য মিডিয়া জগত হয় একটু ভিন্ন।এই জগতে ক্যারিয়ার বানাতে হলে বাজে জিনিসগুলোর সাথে জড়িত থাকতে হয়।নিজের সম্মান নিয়ে কাজ করে টিকে থাকতে পারাটা আমার জন্য গর্বের বিষয়।নিজেকে বিলিয়ে ক্যারিয়ার বানানোটা আমার জন্য খুব কুৎসিত একটা ব্যাপার।তা ছাড়া আমার কাছের মানুষটির ও পচন্দ না। কাজ হাতে নেওয়ার প্রায় এক মাসের মাথায় একদিন স্যারকে ডেকে নিয়ে বললাম-
-স্যার,আমি এই জব কন্টিনিউ করতে পারবো না।
-কেন পারবে না মাহি?কোনো বিশেষ কারন?
-মিডিয়ায় কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না স্যার।মিডিয়া জগতটা ভালো হলে এই কাজটা আমি কখনোই ছাড়তাম না।
-মিডিয়ার সব মেয়েরা কি এক হয়?
-জানি এক নয়।কিন্তু এই কাজ আমার পছন্দ হচ্ছে না।নিজের সম্মান নিয়ে কাজ করতে চাই স্যার।মানুষের তাচ্ছিল্যতা নিয়ে আমি কাজ করবো না।
-তুমি কি অন্যকোনো জব করতে চাও?
-জি।
অবশেষে স্যার তার এক পরিচিত মহিলার বুটিকে কাজ দিলেন আমাকে।অনার্স and মাষ্টারস কমপিলিট হলো।আমি এইবার এপ্লাই করলাম একটি কনসালটেন্সি ফার্মের রিসেপশনে।ইন্টার্ভিউ হলো।বেশ মজার অভিজ্ঞতা ছিল আমারর জন্য।কিছু চাইনিজ লোককেও পেয়েছি ইন্টার্ভিউ দেওয়ার সময়।চাইনিজ বসগুলো প্রতি মাসে আসা যাওয়া করতো।তাদের মধ্যে একজন ফিমেল বস আমার কাজ খুব বেশি পছন্দ করতো।আমাকে তার কাজ ও প্রজেক্ট কমপ্লিট করতে হতো।প্রায় সাত মাস পর এই ফিমেল বস আমাকে জাপানে কাজ করার অফার দিলো।সেলারির হিসাব সব মিলিয়ে বাংলাদেশ টাকার অংকে প্রায় এক লাখের উপরে। কিন্তু আমার সপ্ন ছিল অন্য কিছু। তাই যাওয়া হয়নি।
পরে Bcs কোচিং করলাম। তারপর exam।অবশেষে আমার সপ্নের সিড়িতে পা রাখলাম।আজ আমি BCS উত্তীর্ণ হলাম।
শেষে তাকেই বিয়ে করলাম। যাকে আমি মনে প্রাণে চায়তাম।
এক বছর বাড়ির কারো সাথে কথা হয় নি।চার বছর বাড়ির ভিটায় পা ফেলি নি।হয়তো সময়টা কঠিন ছিল।কিন্তু পারতে আমাকে হয়েছিল।মাঝেমাঝে আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার ফেলে আসা দিনগুলো।আজ যখন দামী ব্র্যান্ডের পারফিউমের ঘ্রাণ আমার দেহে মম করে তখন আমি নিজের মাঝে নিজেই আটকে যাই।তখন হুট করেই আমার মনে পরে যায় ছেঁড়া জুতো একাধিকবার সেলাই করে পরার আনন্দটা,মনে পরে মুখে মলিন হাসি নিয়ে সেই হাল্কা খাবারের স্বাদটা,মনে পরে পুরান কাপড়টাকে ধুয়ে নতুন করে পরার সেই দিনটা।ওই দিনগুলো আজ আমার জীবনে স্মৃতি বহন করে আছে।আমি আমার পথে এগিয়ে গিয়েছি বহুটা দূর।এই পথের পথিক আমি একা-ই।আর কতোটা দূর,আর কতোটা দীর্ঘ যাত্রা আমার জন্য অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই।আমি আমাকে জয়ী করেছি।একটা জীবন যুদ্ধে বীর হয়েছি।বাকিটা পথে লড়ে যেতে আমার কোনো ভয় নেই।যুদ্ধ আসলে আসুক আমি লড়ে যাবো।জীবন গল্প বানায়।গল্প জীবন বানায় না।
Comments
Post a Comment