ফাল্গুনের পলাশ ফুল

ফাল্গুনের পলাশ ফুল
পলাশ ফুলের ছবি

ফাল্গুনের পলাশ ফুল

ইদানিং রূপালিকে প্রায়ই লাল শাড়িতে দেখতে ইচ্ছে হয় মাযেদের, রূপালির চেহারাতে কেমন জেনো একটা বউ বউ ভাব খুজে ফেরে মাযেদ। অনেক কথা বলতে গিয়েও আর বলা হয়না। বছর চারেক হয়ে গেছে যখন দুজন একই সাথে পড়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।  প্রায় বিকেলে দুজন এক সাথে বের হতো।  এভাবে প্রায় পুরো ঢাকা শহরটা যেনো রূপালি আর মাযেদের চিরো চেনা হয়ে উঠেছিলো।

দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলো কি-না কে যানে?

কখনো কেউ কাওকে বলেনি। তবুও একটা দিন না দেখলে দুজনেরই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতো। একদিন তো মাযেদ প্রায়ই কেঁদেই ফেললো।  যখন রূপালী বলল, বাবা আমার বিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। ছেলেপক্ষ দেখেও গেছে। তাদের অনেক পছন্দ হয়েছে আমাকে। কোলকাতাতে নিজেস্ব ৩টে বাড়ি আছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো হলেই বিয়ে।

- আমায় ছেড়ে কোলকাতায় চলে যাবি রুপা? কষ্ট হবেনা তোর?

- সে না হয় দু চারদিন হবে। ভুলে যাবো একদিন সব।  

আর কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় মাযেদ, মাযেদ বুঝতে পারে আর কিছু বলে লাভ নেই। সব পাখিরই ওড়ার স্বাধীনতা আছে। তেমনই রূপালীর ও আছে। মাযেদের চোখে হটাৎই বিন্দু বিন্দু পানি এসে খেলা করে। ঝরে পড়ার আগেই সে পানি মুছে নেয় মাযেদ। এরপর হন্দদন্ত হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে মাযেদ। রূপালি মাযেদকে ডাকতে যেয়েও থেমে যায়।


শহর জুড়ে এক হৈ হুল্লোড় পড়ে গেছে যখন যাকে পাচ্ছে ধরে পিটাচ্ছে, গুলি চালাচ্ছে মিলিটারিরা পথে ঘাটে একসাথে অনেক মানুষ দেখলেই ধরে গাড়িতে উঠিয়ে নিচ্ছে।তারপর জেলে ভরে দিচ্ছে,  কি যে একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে।  মাযেদের ভালো লাগছেনা কিছুই একেতে দেশের এই অবস্থা তার উপর রূপালীর সাথে দেখা হলো বছর চারেক পর। রূপালী আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছে, হাসলে গালে টোল পরে ভ্রু জোরার মাঝে যে ঝাপসা তিলটা ছিলো তা এখন স্পষ্ট।  বছর চারেক আগেও এমন একটা পরিস্থিতি হয়েছিলো যার দরুন রূপালীরা কোলকাতায় পারি জমায়, এরপর আর কোনো খোজ খবর ছিলনা  মাযেদের সাথে। পলাশফুল ছিলো রূপালীর অনেক পছন্দের ফুল। এখন, হয়তো রূপালীর পছন্দেরও পরিবর্তন এসেছে।


ছোফার উপর বসে থাকতে থাকতে পা দুটো এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে মাযেদ।  মা দড়জায় কড়া নারলে সোফা থেকে উঠে গিয়ে দড়জাটা খুলে আবারো শুয়ে পরে মাযেদ।


কিরে এই ভর দুপুরে শুয়ে পড়লি যে, শরীর খারাপ করেছে নাকি?

না মা, একটু চোখটা ধরে এসেছিলো। তাই শুয়ে পড়েছি হাই তুলতে, তুলতে বলল মাযেদ।

-শোন, যা বলার জন্য এলাম। দেশে একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে। শুনেছি যাকে পাচ্ছে তাকেই তাদের ভেনে তুলে ভরে দিচ্ছে হাজতে। আবার কাওকে কাওকে বেধরক পিটিয়েছে। তুই বাবা দু-চারদিন বাসা থেকে বের হসনি।

একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মাযেদ  বলল, চিন্তা করোনা মরণ কপালে থাকলে হবে। না থাকলে হবে না। এই নিয়ে শুধু শুধু চিন্তা করে শরীর খারাপ করে কি লাভ বল? একটু চা বানাও মাথাটা ধরেছে খুব।


খাটের নিচে থেকে স্টোভটা বের করে উনুনে চা চড়িয়ে মা, বলল

দেখ বাবা তুই আমার একটা মাত্র ছেলে তুই না থাকলে আমায় কে দেখবে? শুনেছি কাল নাকি প্রভাতে মিছিল হবে,  তুই যাসনে বাপ। যাদের দু চারটে ছেলে আছে তারা যাক। উত্তরে মাযেদ কিছুই বলল না। হাতে পেয়ালা নিয়ে চা খেতে খেতে কোন ভাবনার বেরাজালে ডুব দিলো কে জানে?


বিকেল হতে না হতেই বেরিয়ে পরল মাযেদ, এমন ভাবে বাসা থেকে বের হলো যেনো কোনো ক্রমেই মা টের না পায়। এখন ফাল্গুনের সময়। সবে শিত শেষ হয়েছে তবুও ঠান্ডা লাগাটা যায়নি। সন্ধে ঘনিয়ে এলেই একটু ঠান্ডা পরে, এসময়। 


আজ ঢাকা শহরের রাস্তাটা বেশ নিশ্চুপ,  কোনো জনমানব নেই।  গাড়িদের ভীড় নেই। রাস্তার দুপাশে সারি সারি দোকান গুলোও বন্ধ শুধু ল্যাম্পপোস্টের আলো গুলো জ্বলে রয়েছে। এমন একটি  শহরই তো মাযেদ চেয়েছিলো। যে শহরে সে আর রূপালী অনায়াসে ডুব দিতে পারবে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দুজন দুজনার হাত ধরে হাটবে।

কেউ দেখবেনা। খুব সকালে কুয়াশা মাখা ভোরে খালি পায়ে বের হবে দুজন তারপর  একগুচ্ছ পলাশ ফুল রূপালীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রেম নিবেদন করবে মাযেদ।

ইচ্ছে গুলো ইচ্ছেই থেকে যায়। পুরুন হবেনা যেনেও ইচ্ছে গুলো মনের মাঝে পুষে রাখতে ভালো লাগে।


মাযেদ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত ৮টা ৩৫ বাযে তেমন রাত হয়নি এখনো তবুও মনে হচ্ছে যেনো মাঝরাত।  আকাশের ক্যানভাসে মিটমিট করে তারা গুলো জ্বলছে। একের, পর এক, মনে হচ্ছে কেউ মরিচ বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে।  কুয়াশা ঝরছে 

উত্তরে হিমেল হাওয়া বইছে। 

এমন সময় রানুদের বাসার সামনে আসতেই মাযেদ দেখলো আশে পাশের সকল বাড়িতে আলো নেভানো থাকলেও রানুদের বাড়ির দোতালায় বাতি জ্বালানো। মাযেদ বাসায় ঢুকবে কি ঢুকবেনা ভাবতে ভাবতেই সহসা দোতালায় উঠে কলিং বেল চাপ দিতেই রানু দরজা খুললো। রানুর এলো চুলের সুগন্ধি বারেবার মাযেদের নাকের ডগায় এসে লাগছিলো। 

রানু হচ্ছে রুপালীর সবচেয়ে কাছের বান্ধুবী। ছোট থেকে দুজনে একসাথেই বড় হয়েছে।  রানুর গায়ের রঙ ঈষৎ কালো। চোখ দুটোতে ভিষন মায়া কাজলহীন চোখ দুটি দেখলে যে কেউ তার মায়ার সাগরে ডুবে যেতো সহজেই।


আরে মাযেদ ভাই যে কি খবর আসো ভিতরে আসো। অনেকদিন পর দেখা আজকালতো এই মুখো হও না বললেই চলে। তো বাসার সবার কি খবর ভালোতো?

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে রানু। মাযেদ প্রথমে ঘরে প্রবেশ করতে ইতস্তত বোধ করলেও পরে প্রবেশ করে।  রানুর কথার উত্তর দিবে এমন সময় ঘরের চারপাশে চোখ বুলুতেই দেখে রানুর বর, 

সোফার এক কোনে বসে রানুর বর সিগারেট ফুকছিলো মাযেদ কে দেখা মাত্রই আধো সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে নিভিয়ে দিলো সোফা থেকে একটু সরে মাযেদ কে বসতে জাগা করে দিয়ে বলল, কালকের খবর শুনেছো নিশ্চয়? কালতো বিরাট একটা ঝামেলা হবে। প্রতিটি এলাকায় ১৪৪ধারা জারি করেছে সরকার।  সকল মিছিল মিটিং বন্ধ। কেউ নিষেধ না শুনলে পুরো গুলি করে শেষ করে দিবে। আজ সারা বিকেলে মাইকে মাইকে এগুলোই বলছিলো।

মাযেদ রানুর বরের দিকে তাকিয়ে বলল, এর একটা হ্যাস্ত ন্যাস্ত করেই তারপর দম নেবো।  রাস্তায় বের হতে দেবেনা মিছিল করতে দেবে না তাতে কি? সকলে তাদের বারির ছাদে উঠে গিয়ে স্লোগান দিবে। 


এসব শুনে রানু ভ্রু কুচকে বলল, এই জন্যই কি আমরা দেশ ভাগ করে ছিলাম? আমাদের কি কোনো স্বাধিনতা নেই? জানুয়ার গুলি জাহান্নামে যাবে খোদার কছম জানুয়ার গুলো জাহান্নামে যাবে।  এই জুলুম খোদা মানবে না।  এরপর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর রানুর বর বলল কি ভাই চা খাবে নাকি? যাও রানু আমাদের দু জনের জন্য দু পেয়ালা চা করে আনো।  রানু উঠতে যাবে তেমন সময় মাযেদ বলল, না ভাই চা খাবোনা আমাকে এখন বেরুতে হবে। তাছারা রুপার সাথে দেখা করাটা জরুরি।  রূপা? রূপা কে ও রূপালীর কথা বলছো মাযেদ ভাই?

হুম।

কতদিন দেখিনা। দেশে ফিরেছে শুনেছি। কিন্তু দেখা করতে পারিনি। তুমি বরং কাল যেয়ো আমাদের ও সাথে নিও। 


কাল কি হবে? তা জানিনা। তবে রূপাকে আজই সাবধান করে দেওয়া উচিৎ।  ও জেনো কোথাও বের না হয় কাল। ও গোলাগুলির আওয়াজে ভিষন ভয় পায়।

আমি গেলাম তোমরা বরং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যেয়ো।


মাযেদ নিচে যাবার কিছুক্ষণ পরেই গুলির আওয়াজে পুরো শহর কেপে উঠলো।  আকাশে মেঘ নেই তবুও চারিদিকটা অন্ধকারে ঢাকা। রানু রাস্তার পাশের জানালাটা খুলে নিচে তাকিয়ে দেখলো মাযেদ ভাই মাটিতে পড়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো মাযেদ ভাইয়ের মুখের উপর পরাতে স্পষ্ট তাকে দেখা যাচ্ছে। 

একটা প্রানীও এগিয়ে এলোনা মাযেদ ভাইকে বাঁচানোর জন্য।  রানু ও তার বর নিচে ছুটে এলো এরপর মাযেদ কে দোতালায় উঠিয়ে নিয়ে এলো। রানু কাঁচের জগ থেকে পানি নিয়ে মাযেদ কে এক গ্লাস পানি দিয়ে বলল, এখন কেমন লাগছে মাযেদ ভাই?

মাযেদ এক চুমুকে সবটুকু পানি খেয়ে বলল,

কিছুটা ভালো।  ভয় নেই

আমি আমার রূপাকে না দেখে মরবো না। তোমরা আমার জন্য ব্যাস্ত হয়ো না। 


ভোরের আযান কানে ভেসে এলো মাযেদের জানটা জেনো বের হয়ে যাচ্ছে পায়ে গুলি লাগায় পুরো ফ্লোর রক্তে ভেসে গেছে। হটাৎ দেখলে যে কেউ ভাববে এখানে কাওকে জবাই করা হয়েছে। 

চারোদিক থেকে রাস্ট্র ভাষা বাংলা চাই স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হচ্ছে পুরো শহর।  মাযেদের ও উঠে সেই স্লোগানে অংশ নিতে ইচ্ছে করছে। মুখে একটা মৃদু হাসি দিয়ে মনে মনেই বলে চলেছে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।

চোখ দুটো আর কিছুতেই খোলা রাখতে পারছেনা মাযেদ। মনে বড় আফসোস থেকে গেলো তার রূপালীর সাথে শেষ দেখা আর হলোনা তার।

মুহুর্তেই গা এলিয়ে দিয়ে শুটান শুয়ে চোখ বন্ধ করে দিলো মাযেদ।

জানটা এতক্ষণে বের হয়ে গেছে।


আজ খুব ভোরেই রূপালীর রানুর বাসায় আগমন।  খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতে এসেছে রুপালী।  এই অন্ধকারেও সকল ছাত্র রা যে যার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ছাদে উঠে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। সবাইকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও কেউ সেই নির্দেশ মান্য করেনি। আজ  প্রভাত ফেরির মিছিল হবে সেই মিছিলে যোগ দিতেই খালি পায়ে এসেছে রুপালী।  কিন্তু কেন যেনো রানুকে দেখার জন্য মনটা তার ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলো তাই সোজা রানুর বাসাতেই উঠেছে রূপালী। 


এতো বছর পর রূপালীকে দেখে রানুর মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠলো।  ভালোকরে রূপার মুখের দিকে তাকিয়ে রানু দেখলো। রূপালী লাল শাড়ি পরেছে কপালে যদিও টিপ নেই তবুও ওকে দেখতে কেমন যেনো বউ বউ লাগছে রূপালীর হাতে এক গুচ্ছ পলাশ ফুল হয়ত কাওকে দেবার জন্য এনেছে সে।  রূপালীর দিক থেকে চোখ নামিয়ে মুহুর্তেই বলে উঠলো রানু মাযেদ ভাই না কাল গুলি খেয়েছে। কাল কতো করে না করলাম তবুও কারো কথা শুনলো না। রানুর কথার প্রতি উত্তরে রূপালী বলল, কখনো কি শুনেছে সে কারো কথা? নিজে যা ঠিক ভেবেছে তাই করেছে। 

মাযেদের কথা বলতেই রানুর মনে পরলো অনেক খন ধরে মাযেদ ভাইয়ের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা। দড়জার কাছে যেয়ে বলল, মাযেদ ভাই আসবো?

আরো কয়েকবার ডেকেও কোনো সাড়া মিললো না। আকস্মিক ঘরের ভিতর ঢুকে দেখলো মাযেদ ভাইয়ের নিথর দেহোটা পড়ে আছে। শারা ঘর রক্তে জমাট বেধে আছে। রানুর চিৎকার শুনে রূপালী সহ রানুর বর ঘরে ঢুকেই দেখে মাযেদের দেহটা পরে আছে ঠোঁট জোড়া জেনো কিছু বলতে চাচ্ছে আর চোখ জোরা খুজছে কাওকে। কি জেনো খুজে ফিরছিলো ও দুটি চোখ। হয়ত ঐ চোখ রূপালীকে খুঁজে বেড়িয়েছে।  ঐ ঠোঁট জোরা বলতে চেয়েছিলো ভালোবাসি রূপা।  তুমি আজ ঘর থেকে বের হয়োনা।  নিজেকে আগলে রেখো।


অভিমানী রূপালীর চোখে পানি টলমল করছে।  কত স্বপ্ন দেখেছিলো দুজন, বার বার পুরোনো স্মৃতির শহরে মাযেদ কে খুজে ফিরছে রূপালি। এতো কষ্টের মাঝেও একটা আনন্দর খবর এসে পৌছালো।  মাইকে মাইকে এনাউন্সমেন্ট করা হলো উর্দুর মতো বাংলাও হবে এ দেশের রাষ্ট্র ভাষা।

®স্পর্শ রনি

সমাপ্ত

Comments

Popular posts from this blog

একজন পতিতার প্রেমের গল্প

What are the benefits of exercising in the morning?

Know the right time to exercise