লাথি
হঠাৎ করেই আরিফ হোসেনের পা গুলো চলার শক্তি হারিয়ে ফেলল। ঘুম থেকে উঠে বসার পর বাম পা টা নিচে রাখার চেষ্টা করতেই তিনি বুঝতে পারলেন পা নড়াবার কোনো ক্ষমতা তার নেই।
কিছুক্ষণ বাকশক্তি হীন ভাবে তাকিয়ে রইলেন পা গুলোর দিকে। সম্ভিত ফিরে পেতেই চেঁচিয়ে ডেকে উঠলেন,
'রুনু....এই রুনু...
বাবার ডাক পেয়ে রুনু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। সবসময় হাসিখুশি থাকা মেয়েটার মুখে আজ কোনো হাসি দেখতে পেলেন না আরিফ হোসেন। মেয়েটি চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-তোমার কিছু লাগবে, বাবা?
তিনি অসহায়ের মত করে বলে উঠলেন,
-আমি পা নাড়তে পারছি না রে, মা।
কথাটা শুনে রুনু ডুকরে কেঁদে ফেলে বলল,
-ডাক্তার চাচা বলেছেন তুমি খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে, বাবা।
কথাটা শুনে আরিফ হোসেন ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন,
-ডাক্তার মানে! ডাক্তার আমাকে কখন দেখে গেল? আমি তো আজকে সকাল থেকে পা নাড়তে পারছি না। ডাক্তার কখন এসেছে?
রুনু বাবার পাশে বসল। এরপর স্বান্তনা দেয়ার ভঙ্গিতে বলল,
-বাবা, তুমি আজ প্রায় এক মাস যাবৎ বিছানায় পড়ে আছো। তোমার পা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তবে চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়ত অধিক কষ্ট থেকে বিষয় গুলো তুমি মনে করতে পারছো না। আমি তোমার হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করছি।
এই বলে রুনু চলে গেল। আরিফ হোসেন বালিশের নিচে থেকে তার ফোন টা বের করলেন। আজকের তারিখটা জানা তার প্রয়োজন। ফোনের স্ক্রিনে আজকের তারিখ দেখে কিছুটা চমকে উঠলেন।
আজ ১১ সেপ্টেম্বর। কিন্তু তার স্মৃতিতে আছে ১১ আগস্ট পর্যন্ত। তার অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল সেদিন। তার বাসার ১২ বছরের কাজের ছেলেটা তাকে চা দিতে গিয়ে হোঁচট খেল। এমন দামি একটা কাপ ভাঙার অপরাধে তিনি ছেলেটিকে রেগে লাথি মারলেন। তারপর...তারপর কী হয়েছিল? কিছু মনে পড়ছে না কেন তার?
রুনু চলে এসেছে। তার এক হাতে একটা বড় বাটিতে পেস্ট মাখানো একটা ব্রাশ আর অন্য হাতে এক মগ পানি।
ভয়ে ভয়ে সোবহান আরিফ হোসেনের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো। আজকেও তার হাতে এক কাপ চা। এ বাড়িতে তাকে সব কাজ সামলানোর জন্য আনা হলেও তার দায়িত্ব এখন শুধু আরিফ হোসেনকে চা পৌঁছে দেয়া। ছোট এই ছেলেটিকে দেখে রুনু কিছুটা রেগে গিয়েছিল। এত ছোট বাচ্চাকে কি কেউ ঘরের কাজ করানোর জন্য রাখে! শেষমেশ তাকে রাখা হলো। কিন্তু রুনু সোবহানকে কড়া হুকুম দিয়েছে তাকে অন্য কাজ করতে হবে না। ঘরের সব কাজ যে রুনুই সামলায় এই বিষয়টা আরিফ হোসেন জানেন না।
আরিফ হোসেন, সোবহানকে দেখে চিনতে পারলেও নাম মনে করতে পারলেন না। ছেলেটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
-বড় সাব, আপনের চা।
-চা নিয়া ওইখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার হাত তো আর আইনের মত বিশাল লম্বা না। ঘরে আয়।
সোবহান ঘরে ঢুকল। চায়ের কাপ টা আরিফ হোসেনের হাতে দিলো। চায়ে চুমুক দিয়ে আরিফ হোসেন জিজ্ঞেস করলেন,
-তোর নাম কী?
-জি সোবহান।
-জি সোবহান আবার কেমন নাম?
সোবহান এই প্রথম আরিফ হোসেনের কোনো কথা শুনে হেসে ফেলল। আজকে তার সাবের কথা গুলো মজার মনে হচ্ছে।
হেসে বলল,
-জি নামের মধ্যে নাই। শুধু সোবহান।
-আচ্ছা। শুধু সোবহান, আমার সামনে বস।
সোবহান এবার আরিফ হোসেনের ভুল ভাঙালো না। তার ভীষণ মজা লাগছে। সে বসল। আরিফ হোসেন জিজ্ঞেস করলেন,
-আমি যে এখন চলা ফেরা করতে পারি না তুই জানিস?
-জানমু না ক্যান? জানি তো। রুনু আপায় কত কান্নাকাটি করল। আমিও তো কানসিলাম।
আরিফ হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। বলবেন না ভেবেও বলেই ফেললেন,
-আমার সেসব কিছু মনে নাই। এই এক মাসের সব স্মৃতি আমার মাথা থেকে মুছে দেয়া হয়েছে।
সোবহান ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। আরিফ হোসেন বললেন,
-আচ্ছা, তুই যা এখন। আর শোন আমি তোকে লাথি মেরেছিলাম। বড্ড ভুল করে ফেলেছি। আমাকে মাফ করে দিস।
সোবহান চলে আসলো। সেদিন লাথি খেয়ে সোবহানের কান্না না পেলেও, আজকে কেন যেন তার ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। আগে মনে হতো এই লোক রুনু আপার বাবা হতেই পারেন না। নয়ত রুনু আপা এত ভালো হলেও উনি তেমন না কেন? আজকে মনে হচ্ছে তার ধারণা টা ভুল।
সব কাজেই আরিফ হোসেনকে এখন অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তার জন্য একজন নার্স রাখা হয়েছে। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও ভীষণ রকম অসহায় লাগছে তার। তিনি চোখ বন্ধ করলেই তার সুস্থ থাকার দিন গুলোর কথা মনে পড়ে যায় বারবার। যে সময় তিনি হাঁটতে পারতেন, চাইলে কাউকে লাথিও মারতে পারতেন। এখন সেসব স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে তার।
সকালে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো আরিফ হোসেনের। পারবেন না জানা সত্বেও, প্রতিদিনের মত আজকেও পা নাড়ানোর চেষ্টা করলেন। অবাক হয়ে খেয়াল করলেন তার পা নাড়াতে পারছেন তিনি। খাট থেকে নিজের পায়ে নেমে দাঁড়ালেন। এখন আনন্দে প্রায় লাফাচ্ছেন।
চেঁচিয়ে রুনু রুনু বলে ডাকলেন। রুনু রুমে এসে বলল,
-কী হয়েছে বাবা?
-এই দেখ আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি। আমি আবার হাঁটতে পারছি।
রুনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-তুমি তো সুস্থই আছো বাবা। তোমার আবার কী হয়েছিলো?
আরিফ হোসেন চুপ করে গেলেন। হুড়মুড় করে বালিশের নিচে থাকা ফোনটা বের করলেন তিনি। আজকে কত তারিখ? মোবাইলের স্ক্রিন টা অন করতেই ভেসে উঠল আজকের তারিখ ১১ আগস্ট, ২০২১।
কিছুক্ষণ বাদে এক কাপ চা হাতে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সোবহান। তার কণ্ঠে
'বড় সাব, আপনের চা' কথাটা শুনে চমকে তাকালেন আরিফ হোসেন।
(সমাপ্তি)
লাথি
অরণী মেঘ
Comments
Post a Comment