আত্মসংশোধন

সারি সারি লাশের মধ্যে স্বামীর লাশটা খুঁজছে কণিকা। আজকের দিনেও তার চোখে পানি নেই, কষ্ট নেই। কিছুক্ষণ আগেই ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনা হয়েছে। ফোন করে কণিকাকে কেউ জানিয়েছে তার স্বামী সাজিদ নাকি বাস দুর্ঘটনায় মারা গেছে তাই সে হাসপাতালে এসেছে। লাশগুলোর এত ক্ষতবিক্ষত বিশ্রী অবস্থা যে চেনা মুশকিল। কণিকা মনে মনে ভাবছে, " ইস ! আমার টাকার মেশিনটা নষ্ট হয়ে গেল"। একটা মানুষের মাথায় এত নির্মম চিন্তা কিভাবে আসতে পারে যার স্বামীর কিছুক্ষণ আগে দুর্ঘটনা হয়েছে। সম্ভাব্য যে সে মারা গেছে। আজ সকালে অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেও সাজিদের সাথে ঝগড়া হয়েছে কণিকার। সেটা অবশ্য টাকা নিয়েই। সবসময় কণিকা টাকা টাকা করে। সাজিদ একটা প্রাইভেট ফার্মে ভালো মানের চাকরি করে কিন্তু কণিকার এত বেশি টাকার প্রয়োজন হয় যে সে চাহিদা পূরণ করে উঠতে পারছে না। 

          অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে লাশ না পেয়ে কণিকা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেল। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবছে,
" বাড়ির লোককে কি জানাবো যে তাদের জামাই মারা গেছে? সাজিদের ফ্যামিলিকে কি জানানো উচিত? তারা তো শুনলে অনেক কষ্ট পাবে। তাদের তো ছেলে। আর আমার বাবাকে জানালে তো বাবার হার্টফেইল হয়ে যাবে। কারণ বাবার পছন্দের টাকাওয়ালা জামাই বলে কথা। আচ্ছা মুশকিল তো ! কি করবো বুঝতে পারছি না। যাক লাশ পৌছালে এমনিই সবাই খবর পেয়ে যাবে। আমাকে এসব ভেবে সময় নষ্ট করতে হবে না। ব্যাপক লস হয়ে গেল। সামনে ঈদ ভেবেছিলাম জমজমাট শপিং করবো তা আর হয়ে উঠলো না"।

কয়েক ঘন্টা চলে গেল। শুয়ে শুয়ে এই কাত ঐ কাত করছে কণিকা। ঘুম আসছে না ওর। মনে মনে ভাবছে,
" আচ্ছা আমার এত অস্থির লাগছে কেন ? আমার তো শুধু টাকার দরকার ছিল। ভালোবাসা টালোবাসা হয়ে যায় নি তো আবার সাজিদের ওপরে? নাহ্ হতেই পারেনা। কিভাবে হবে ভালোবাসা? বাবা তো আমাকে টাকার সাথে বিয়ে দিয়েছিল। আমি যাকে ভালোবাসতাম তার টাকা ছিল না বলেই তো বাবা আমাকে জোর করে সাজিদের সাথে বিয়ে দিয়েছে। আমিও শুধু টাকা টাকাই করে গেছি। আমার আর দোষ কোথায়?
যাই হোক সাজিদ মানুষটা ভালো ছিল। এত বিরক্ত করতাম সবসময় চুপচাপ সহ্য করে নিতো। কখনো অভিযোগ করতো না। আমি ইচ্ছা করে ঝগড়া করতাম ওর সাথে যেমনটা আজ সকালে করেছি। হা হা। আমার নাকি শপিং করতে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। হাস্যকর না? আচ্ছা আমি তো আবিরের সাথে পাঁচশো টাকার জামা পরেই সুখে দিন কাটাতে চেয়েছিলাম। এক জামাকাপড় বারবার পরে অভ্যস্ত হতে চেয়েছিলাম। আমি টাকা সঞ্চয় করে আমাদের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে চেয়েছিলাম। আমি কি এই মানুষটা ছিলাম যে আচরণ আমি সাজিদের সাথে বিগত কয়েকটা মাস করে গেছি? লোকটা আজ শেষপর্যন্ত মরেই গেল আমার অত্যাচারে। তার লাশটা অন্তত বাড়িতে আসা ডিজার্ভ করে। নাকি লাশটাও পাবো না? "

            অজান্তেই কণিকার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে নিজেও জানেনা। বিছানাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কণিকার। পাশেই সাজিদ প্রতিদিন শুয়ে থাকে। ভালো লাগুক না লাগুক মানুষটা তো থাকে। বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলো কণিকা। আর নিজেকে পাথররূপে প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই ওর। অঝরে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো সে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো ওর, " সাজিদ আমি তোমাকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু তুমি তো সাজা প্রাপ্তির মানুষটা ছিলে না। ছিল অন্য কেউ। অথচ আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার শেষ সুযোগ টাও পেলাম না। যখন তুমি ছিলে তোমার বিন্দুমাত্র মুল্য দেই নি। আজ আমি তোমাকে ভীষণ মিস করছি। " 

        কণিকার কান্না যেন থামছেই না। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে ওর। হঠাৎ করেই কলিংবেলটা বেজে উঠল। কণিকা মনে মনে ভাবলো লাশটা হয়তো এসেই গেছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে ওর। মেঝে থেকে উঠার শক্তি পাচ্ছে না সে। কলিংবেল টা বারবার বেজেই চলেছে। উঠে দরজা টা খুলে কণিকা চমকে গেল। ওর সামনে সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে। এটা কিভাবে সম্ভব? কণিকা কান্নাজড়িত কন্ঠে সাজিদকে জড়িয়ে ধরলো। সাজিদ বেশ অবাক হলো। সে ভাবছে, " যেই বউ সকালে এত ঝগড়া করলো তার হঠাৎ হলো টা কি। আবার চোখেও পানি। "

সাজিদ কণিকাকে জিজ্ঞেস করলো,
-- তুমি ঠিক আছো?
-- আমি ঠিক আছি কি না আছি সেটা পরের
   বিষয়। তুমি যে বেঁচে আছ, সুস্থভাবে
   বাড়ি ফিরেছো এটাই অনেক। 
-- মানে? আমি বেঁচে থাকবো না কেন? আমার
   আবার কি হবে?
-- হাসপাতাল থেকে আমাকে ইনফর্ম করা
   হয়েছিল তুমি যে বাসে ছিলে তার দুর্ঘটনা
   হয়েছে। অধিকাংশ লোক মারা গেছে। আমি
   হাসপাতালে গিয়েছিলাম তোমাকে খুঁজতে।
   অনেকবার তোমার ফোনে ফোন দিয়েছিলাম।
   অফ ছিল।
-- না। আমি বাস থেকে মাঝপথে নেমে
   গিয়েছিলাম কারণ আমাকে অফিসের যেই
   ডিলটার জন্য চট্টগ্রামে যেতে বলা হয়েছিল
   সেটা ক্যানসেল হয়ে গেছে। আমি সকালে
   মেসেজ চেক করি নাই। পরে আমার কলিগ
   আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। আর আমার
   ফোনে চার্জ শেষ হয়ে অফ হয়ে গেছে। আমি
   তো জানিই না বাসটা এক্সিডেন্ট করেছে।
-- প্লিজ একটু চুপ থাকো। 
কিছুক্ষণ পরে সাজিদ বললো,
-- তোমার টাকাটা আমি ম্যানেজ করেছি।  
   কালকে পেয়ে যাবা।
-- আমার কোন টাকা পয়সার প্রয়োজন নেই।
   কোনদিনই ছিল না। আমি বাবার ওপর রাগ
   করে দিনের পর দিন তোমার সাথে অন্যায়
   করে গেছি। কিন্তু আমি এমন মানুষ নই। বাবা
   শুধুমাত্র টাকার জন্য আমাকে জোর করে
   তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছিল। তাই আমি
   ইচ্ছাকৃত এই অত্যাচারটা করতাম। আজ
   তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি ভেবে আমি ভেতরে
   ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার দম বন্ধ
   হয়ে আসছিল। 

সাজিদ কণিকাকে থামিয়ে বিছানায় বসিয়ে একগ্লাস পানি হাতে দিয়ে বলল,
-- রিল্যাক্স। আমি ঠিক আছি। যেহেতু তোমার
   বাবা তোমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে তাই
   জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি আমার সাথে আর
   থাকতে চাও না?
-- আমি থাকতে চাই সারাজীবন। আমি জীবন
  থেকে তোমার সাথে অনেকটা পথ এগিয়ে
  গেছি সাজিদ। আমার কোন পিছুটান নেই
  আর। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। 
-- ক্ষমা করতে পারি এক শর্তে।
-- কি শর্ত?
-- আমাকে ভালোবাসতে হবে। 
-- মনে হয় অলরেডি ভালোবেসে ফেলেছি। 
সাজিদ আর কণিকা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল। 
  
(সমাপ্তি) 
ছোটগল্প : আত্মসংশোধন
লেখনীতে-- নূর-এ সাবা জান্নাত

Comments

Popular posts from this blog

একজন পতিতার প্রেমের গল্প

What are the benefits of exercising in the morning?

Know the right time to exercise