সোনা এবং সংসার
দেবরের বিয়ে নিয়ে ভীষণ খুশি ছিলো সাঞ্জিদা৷ কিন্তু তার থেকে দিগুণ কষ্ট আর মন খারাপ হলো, যখন শুনলো বিয়েতে ঠিক করা তিন ভরি সোনার মধ্যে দুই ভরি সোনা তাকেই দিতে হবে।
কোনো মেয়ে কখনোই চাইবে না নিজের বিয়ের সোনা অন্য কাউকে দিতে।
আর আকদের আংটি তো কোনো ভাবেই চাইবে না দিতে।
কিন্তু সাঞ্জিদার সাথে ঠিক তাই ঘটতে যাচ্ছে।
বিয়েটা নিয়ে যতোটা আনন্দিত ছিলো সে, সোনার বিষয়টা শোনার পর থেকে এই বিয়ে নিয়েই বিন্দুমাত্র খুশি না এখন।
শাশুড়ী নানান ভাবে তাকে বোঝাচ্ছেন, বউমা তোমার সোনাগুলো দিয়ে দাও। আরিফ (দেবর) তো ওর বউকে সোনা এমনিতেই দিবে। হয়তো কিছুটা দেরি হবে। সব ঠিক হওয়ার পর যদি এই সোনার জন্য বিয়েটা ভেঙে যায়, তাহলে আমাদের কতোটা সম্মান যাবে বুঝতে পারছো?
এরকম অনেক কথাই কয়েক দিন ধরে শোনে আসছে সাঞ্জিদা। তার কান পঁচে গিয়েছে এসব শুনতে শুনতে। তার খুব ইচ্ছে হয় বলতে।
"আম্মা আপনার মেয়েরও তো ৪ভরি সোনা আছে। তার কাছে চাচ্ছেন না কেন? চাইলে কী সে দিবে না তার ভাইয়ের বিয়েতে নিজের সোনাগুলো?"
কিন্তু প্রশ্নগুলো মনের মধ্যেই রয়ে যায়। দুই ঠোঁটে তা কখনো ফোটাতে পারেনি। 'ঠোঁট' যা অকারণেও ফুটন্ত পানির মতো টগবগ করে, আবার বিশেষ কারণগুলোর সময় বরফের মতো জমে যায়।
লালচে আকাশ কালো রঙ ধারণ করেছে। পাতায় জমে থাকা কুয়াশার পানি থেমে যাওয়া বৃষ্টির মতো ঘরের ছালে পড়তেছে। সেই কোন এক অজানা জায়গা থেকে শেয়ালের ডাকও কানে আসছে তার।
অন্যদিন শেয়ালের ডাক শুনলে সে বলতো, কই গো সাঞ্জু! তোমার কম্বল দিয়ে আসো তো ওই অসহায় শেয়ালের দলদের। ঠান্ডায় কেমন গান করে ঘরের গিন্নীদের কাছে কাঁথা-কম্বল চাচ্ছে দেখো।
সাঞ্জিদাও তখন মুচকি হেসে বলতো, তোমার এতো ভালোবাসা ওদের জন্য, তাহলে তুমিই দাও।
কিন্তু আজ দুটো মানুষ চুপচাপ বসে আছে বিছানায়।
নিয়ম করে ঠিকই লালচে আকাশ কালো হচ্ছে, শেয়াল ডাকছে, কুয়াশা টপটপ করে ঘরের ছালে পড়ছে। কিন্তু মানুষগুলোর মনে আনন্দ নাই।
মন ভালো থাকলে নাকি কান্নার মানুষকেও ফুরতি করে হাসানো যায়। আর যদি মনে গভীর জঙ্গলে থাকা বা গভীর সাগরে থাকা মানুষদের মতো ভয় কাজ করে, তাহলে হাসতে থাকা মানুষটিকেও কান্না করিয়ে দেওয়া যায়।
কোনো কিছু কী ভেবেছো সাঞ্জু?
স্বামীর প্রশ্ন শুনে চোখ মেলে তাকালো সে।
আর বলল,
তোমার কী মনে হয় সোনাগুলো দিলে আর পাবো?
আসিফ চুপ থাকলো,
ভবিষ্যৎ তো সে জানে না। চোখের সামনে তো কতো পরিবারেই ভাঙন ধরেছে এই সোনা দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমে। কী বলবে সে?
স্বামীকে চুপ থাকতে দেখে সে আবারও বলল,
মানহাকে চিনো? ওই যে ঢাকা থেকে স্বামী আর নিজের দুই বাচ্চাকে সাথে নিয়ে আমাদের এই জায়গায় আসছে।
আসিফ মাথা নেড়ে বুঝাতে চাইলো চিনে সে।
সাঞ্জিদা বলল,
সে দেবরের বিয়েতে নিজের আড়াই ভরি সোনা দিয়েছিল। সেই সোনা আর ফিরত পায় নি। আরো শুনতে হয়েছে, সোনা নাকি সে বিক্রি করে টাকাগুলো নিজের বাবার বাড়ি দিয়েছে। সেই টাকায় নাকি তার ভাই বিদেশে গিয়েছে।
সেদিন চায়ের গল্পে বসে এসব লুকানো কষ্টের কথাগুলো সে আমায় বলেছিল। আচ্ছা চোখের সামনে এতো অহরহ ঘটনা দেখে কীভাবে পারি আমার সোনা অন্য একজনকে দিতে?
স্ত্রীর কথায় আসিফ শুধু চুপ করেই রইলো।
সে আবারও বলল,
আমার মায়ের মুখে শুনতাম, আগের যুগে নাকি কাবিনে জমি দেওয়া হতো। সেই জমি নাকি আবার অন্য ভাইয়ের বিয়েতেও দিয়ে দিতো। সেই হিসেব আমি বুঝতাম না। বুঝতেও চাইতাম না। শুধু বলতাম, তোমাদের আগের যুগের গল্প রাখো তো মা।
আসিফ কোনো কথা বলল না, কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুম ত্যাগ করলো সে।
সাঞ্জিদা ঠিক করলো সে কোনো ভাবেই নিজের সোনা দেবরের বউকে দিবে না। এর জন্য যদি সবার চোখে খারাপও হতে হয় তাহলে তা-ও হতে রাজি সে। এই সোনা নিজের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ। কীভাবে হারাতে চায় এই অমূল্য সম্পদ।
বড় বউমা সোনাগুলো কী তোমার কাছেই আছে?
শাশুড়ির প্রশ্নে শুধু হুম বলল সাঞ্জিদা।
শাশুড়ি হেসে বললেন,
দেখো মেয়ের কাজ। নিজের কাছে সোনা রেখে কেন আমাদের এতো চিন্তা করাচ্ছো?
সাঞ্জিদা কিছু বলতে যেয়েও চুপ হয়ে যায়। নিজ স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকালো শুধু সে।
ঘরভর্তি মানুষ। শাশুড়ি ঠিক সময়েই কথার গুলি ছুড়েছেন। না করলেই সবাই বলবে, ছি এই মেয়ে এতো লোভী। মুখের উপর না করে দিলো।
আম্মা আপনার সোনা কোথায়? আপনার ছেলের মুখে তো শুনলাম আমাকে দেওয়া ২ভরি সোনার মধ্যে এক আনা সোনাও আপনার না। সব নাকি আব্বা কিনে দিয়েছেন।
সাঞ্জিদার কথায় উনি হালকা রেগে বললেন,
বাহ তুমি দেখি আমার ছেলের কাছে বিয়ের সোনার কৈফিয়ত নিয়েছো। নির্লজ্জ মেয়ে।
আম্মা স্বামীর কাছে কিছু জানতে চাওয়া যদি কৈফিয়ত হয় আর লজ্জাহীন হয় তা তো জানতাম না।
উনি এবার একটু বেশিই রেগে গেলেন।
আর বললেন,
বললেই তো হয় যে তুমি সোনা দিবে না। এতো কথা শুনানোর কি আছে? মা মেয়ে দুটোই এক রকম। সোনা নিবো বলছি, এই জন্য হয়তো মায়ের কাছ থেকে এসব বুদ্ধি নিয়েছো।
সাঞ্জিদা এসব কথা শুনে অনেকটাই রেগে যায়। কিন্তু রাগকে মাটিচাপা দিলো আর বলল,
আম্মা শুনুন! কিছু না জেনে কাউকে নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক না। আমার মা একটু পূর্বেও আমাকে বুঝিয়েছেন সোনাগুলো দিয়ে দিতে। আমার মা এক পর্যায়ে রাগ করে ফোনটাই কেটে দিয়েছেন। কারণ আমি সোনা দিবো না বলছি। আপনি কিছু না জেনেই আমার মা কে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করে ফেললেন। আপনি অনেক মানুষকেই আমার পিছনে লাগিয়েছেন আমার সোনা নেওয়ার জন্য। সেটা আমি জানি। শুনুন, সোনা আমি দিবো না। আরিফ যদি তার বউকে এখন সোনা না দিতে পারে, তাহলে তাকে কিছুদিন পর বিয়ে করালেও তো হয়। আমি জানি আমার দেবর খুব ভালো। আমি চোখ বন্ধ করে সোনাগুলো দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু ওর বউ? আপনিও যেমন এই ঘরের বউ, আমিও তেমন। আর যে আসবে সেও বউ। দেখুন আপনার আর আমার মতের কতো ভিন্নতা। তাহলে বুঝুন নতুন বউয়ের কেমন মত হতে পারে? আমার সোনাগুলো আরিফের বউয়ের পছন্দ হলো, সে দিতে চাইলো না। আরিফ নিতে পারলো না। আস্তে আস্তে পরিবারের ভাঙন শুরু। আরিফ কয়েক মাস হলো চাকরিতে ঢুকলো। কিছুদিন অপেক্ষা করলেই তো সে সোনা কিনে নিতে পারবে৷ তাহলে এতো তাড়াহুড়ো কেন আম্মা? আরিফকেও দেখলাম না একটাবার আমাকে বলতে সোনা দাও। কিন্তু আপনি? আর সম্মানের কথা বলে যাচ্ছেন। কেন মানুষ জানবে না, আমার সোনা দিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন? যখন এই সোনার সূত্র ধরে সংসারে অশান্তি আসবে, তখন কী খুব সম্মান থাকবে?
শাশুড়ি মা এইবার চিৎকার করে বললেন,
সোনা তো দিবে না। তাহলে এতো বকবক করারও প্রয়োজন নাই। তোমার সোনার জন্য আমার ছেলের বিয়ে আটকে থাকবে না। তুমি এতো লোভী, আগে জানলে কখনো আমার ছেলের জন্য নিয়ে আসতাম না।
সাঞ্জিদা হেসে বললো,
আম্মা লোভী হলে নিশ্চয় আমার কাবিনের তিন লক্ষ টাকা আপনার ছেলেকে মাপ দিতাম না। বিয়ের রাতে যখন আপনার ছেলে আমায় ১লক্ষ টাকা দিয়ে বলেছিল, বাকি টাকা আমি বিয়ের ১বছরের মধ্যেই দিবো। লোভী হলে ঠিকই আমি নিয়ে নিতাম। আপনার ছেলের ঋণ করে টাকাগুলো আমি অনায়েসে নিতে পারতাম। কিন্তু সে আমার স্বামী। আমি আমার মনের আনন্দে সব একটি টাকাও নেই নি। আর আপনি আমাকে লোভী বলছেন। দেশে অহরহ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে কাবিনের টাকা নিয়ে। মেয়েগুলো কাবিনের টাকা চায় কিন্তু স্বামী দিতে হিমসিম খায় বা দিতেই চায় না। সেখানে আমি হয়ে গেলাম লোভী?
শাশুড়ি মা এইবার চুপ রইলেন। সাঞ্জিদা আবারও বলল,
আমি চাই আরিফ তার স্ত্রীকে সোনা দিয়েই বিয়ে করুক৷ তবে সেটা নিজের বা আব্বার কেনা টাকার। আমাকেও তো আব্বা সোনা দিয়েছেন।
আম্মা আপনার আর আমার মধ্যে থাকা মধুর সম্পর্কে এই তুচ্ছ সোনা নিয়ে ভেজাল সৃষ্টি করে ফেলতে যাচ্ছেন। আপনি যেভাবে আপনার সোনা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ সহ আরো অনেক খরচ চালিয়েছেন। আমিও সেভাবেই আমার ছেলেমেয়েদের জন্য আমার এই সোনাগুলো রেখে দিতে চাই। আপনিই তো মাঝেমধ্যে বলে থাকেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের সম্বল ওই মায়ের সোনা আর বাবার কিছু জায়গা জমি। আমিও না হয় আমার সন্তানদের খারাপ দিনগুলোর জন্য এই সোনাগুলো রেখে দিলাম। আপনি যেভাবে আপনার সন্তানদের সব আশা পূরণে অলংকার হারিয়েছেন, আমিও না হয় এসব হারিয়ে আপনার স্থান দখল করে নিবো৷ আমিও যে একদিন মা হবো। সন্তানের জন্য এইটুকু তো একজন বাবা মা-ই করে থাকে আম্মা।
আরিফ এর শশুড় বাড়ির সাথে কথা বলে দেখতেও তো পারেন, হয়তো ওরা বুঝবে। সবারই তো ছেলেমেয়ে আছে। আর আর আরিফ তো নিজের স্ত্রীকে সোনা বিহীন রেখে দিবে না। প্রতিটা স্বামীই তো স্ত্রীর জন্য দামী জিনিসগুলোই কিনতে চায়।
দুঃখিত আম্মা। আসলে সুখী পরিবারের অশান্তি সৃষ্টি করতে চাই না। কিন্তু আমি সোনা দিতে পারবো না। কোনো নারীই চাইবে না নিজের বিয়ের সোনা কাউকে দিতে। আর কোনো নারীও চাইবে না অন্যের সোনা নিজের বিয়ের দিন গায়ে দিতে।
শাশুড়ি কোনো কথা বললেন না। নিজেই তো নিজের সোনাগুলো নিজের দেবরকে দেন নি। এবংকি নিজের ভাইয়ের বিয়ের দিনও না৷
কিছুক্ষণ চুপ থেকে চলে গেলেন নিজের রুমে।
সাঞ্জিদা নিজের রুমে চলে আসলো। কীভাবে এতো কথা বললো, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না সে।
তবে যতো পরিবারে অশান্তি দেখেছে সে, তার পিছনে এমন কারণগুলোই ছিলো বেশি।
হালকা ঝগড়া হলেই বড় বউ মেজো বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলবে আমার সোনা দিয়েই তোমার বিয়ে হয়েছিল৷ কোনো মেয়েই এসব শুনতে চায় না।
আয়নায় স্বামীর চেহারা দেখে সাঞ্জিদা বললো,
বিয়ের পর আম্মার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নিবো নে। তবে আমি ভুল কিছু বলিনি উনাকে। ক্ষমা চাইলে উনিও খুশি হবেন। বড়দের কাছে হাজারবার ক্ষমা চাওয়া যায়। তুমি তো বড় হয়েও দিনে শতশত বার আমায় সরি বলো।
কথাগুলো বলে সাঞ্জিদা হাসলো। আসিফ নিজের মায়ের মুখ দেখে বুঝতে পারছে সাঞ্জিদার উপর অতো রেগে নাই৷ আর ক্ষমা চাইলে তো রাগটা জানালা দিয়ে পালাবে।
আসিফ শুধু হাসলো। সোনা নিয়ে এতো কাহিনি।
সমাপ্ত
ছোটগল্প: সোনা এবং সংসার
লেখক: হানিফ আহমেদ
Comments
Post a Comment