নাকফুল
খারাপ খবর যে বাতাশের আগে ছড়ায় সেটা আরেক বার প্রমান হলো ।
দুলু ভাই নাকি কোন হোটেলে বাজে মেয়েছেলে নিয়ে ধরা খেয়েছে। কয়েকটি মিডিয়া আবার সেটার নিউজ কভারেজ করেছে। তারপর থেকেই আমাদের ফ্যামিলিতে তোলপাড় শুরু। নিকট পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে একটা ঢিঢি পড়ে গেছে। লজ্জায় আমরা মাথা তুলে কারো সাথে কথা বলতে পারি না।
..
জানতে চান দুলু ভাই কে? দুলু ভাই হচ্ছে আমার একমাত্র বড় বোনের হাসব্যান্ড । ঠিকাদারি ব্যবসা করেন।
আমরা তিন বোন দুই ভাই। নিলু আপা সবার বড়। নিলুপার গায়ের রঙ শ্যামলা। জন্মগত ভাবেই তার বা'পা থেকে ডান পা ছিল সামান্য খাটো। ফলে কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটেন। অন্যদিকে আমাদের বাবা সামান্য স্কুল শিক্ষক। আজকাল পাত্রীর বাবার টাকা না থাকলে বিয়ের বাজারে পাত্রীর কদর এমনিতে কম। তারপর আবার নিলুপার এই সমস্যা।
এদিকে আমার অন্য দুই বোনও বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। যতোই দিন যাচ্ছিল বাবা আর মায়ের কপালে চিন্তার ভাজ ফুটে উঠছিল। সব পাত্রই নিলুপা কে দেখে ফিরে যাচ্ছিল।
তারপর একদিন হটাত দুলু ভাইয়ের আবির্ভাব। ঘটক চুন্নু মিয়া এই সম্পর্ক নিয়ে আসে। দুলু ভাই ছিলেন খুব হ্যান্ডসাম। সাধারণ ছেলেরাই যেখানে নিলুপাকে রিজেক্ট করে যাচ্ছিল সেখানে কীনা..। আমরা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।
অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুলু ভাই বলল, "যে সমস্যা মানুষের নিজের তৈরি না সে সমস্যা কখনো বিয়ের জন্য বাঁধা হতে পারেনা। আপনাদের মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে।"
দুলু ভাইয়ের কথায় সেদিন খুশিতে আমাদের চোখে পানি এসে যায়। পৃথিবীতে এখনো এত ভাল মানুষ আছে! নিলুপার কপালে যে এত ভাল বর জুটবে আমরা ভাবতেই পারিনি।
ভুল ভাঙ্গলো কয়েক মাস পর।
জানতে পারলাম দুলু ভাইয়ের নাকি আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। ডিভোর্স হয়ে গেছে। কোন এক হত্যা মামলার আসামি নাকি। কিছুদিন আগে জামিন পেয়েছেন।
তারপর থেকে তার সাথে আমাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। প্রয়োজন ছাড়া দুলু ভাইয়ের সাথ তেমন কথা হয় না। তার ভয়ে আমরা তটস্থ থাকি।
..
রাতে ঘুমানোর জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। মা হটাত আমার ঘরে ঢুকলেন।
"খবর শুনেছিস?"
"কী খবর?"
দুলু নাকি ছাড়া পেয়েছে। এই মাত্র নিলু ফোন করেছিল।
"ও আচ্ছা।" নির্লিপ্ত গলায় বললাম
খেয়াল করলাম মা'র চেহারায় উচ্ছ্বাস। অথচ এই ক'দিনে টেনশনে মার চেহারা এতটুকু হয়ে গিয়েছিল। বাবা তো লজ্জায় কারো সাথে কথাই বলছেন না।
বললাম, "মা একটা বলবো ?"
"কী কথা?"
"নিলুপা কে ছাড়ান দিয়ে নিয়ে এসো।"
মা একটু চুপ থেকে বললেন, "বাবারে মুখে বললেই সব করে ফেলা যায় না। এমনিতে ওর সমস্যা। তার উপর ওর একটা মেয়ে আছে, চাইলেই কী সব হয় ? মেয়ে হয়ে জন্মালে বুঝতিস। "
দু'জনই কিছুক্ষণ নীরব থাকলাম।
মা চলে যেতে গিয়েও কী ভেবে থামলেন।
"একটা কাজ করবি লিটু ?"
"কী?"
"কাল একবার নিলুদের এখান থেকে ঘুরে আসবি?"
"তোমার কী মাথা ঠিক আছে মা? কী করে ভাবলে ঐ বদমাশটার বাসায় যাব? কোয়াইট ইম্পসিবল, মরে গেলেও না।"
"বাবারে বোন বলে কথা!"
আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। মা নিঃশব্দে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
..
ঠিক কি হল জানি না। সম্ভব না সম্ভব না বলেও দুদিন পর সন্ধ্যায় হটাত নিলুপার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম।
ডোরবেল বাজাতেই স্বয়ং দুলু ভাই এসে দরজা খুলল।
"আরে লিটু যে, কেমন আছ ?"
কাঠ গলায় বললাম, "ভাল।"
"বাড়িতে বাবা-মা সবাই ভাল তো?"
"ভাল"
"বাবার ডায়াবেটিস, প্রেসারের অবস্থা এখন কেমন?"
"আছে।"
"খুব সাবধান। বাবাকে কোন টেনশন কোন প্যারা দেয়া যাবেনা। কেয়ামত হয়ে গেলেও না।"
ক্রুর হাসি হেসে মনে মনে বললাম, বজ্জাত কোথাকার!
দুলু ভাই উচু গলায় ডাকলেন, "এই দেখে যাও কে এসেছে।"
ভেতর থেকে নিলুপা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এল। সাথে ওর পাঁচ বছরের মেয়ে রাইনা।
"মামা মামা" বলে রাইনা ছুটে এসে আমার কাছে বসলো। চিপস, চকোলেট বাড়িয়ে দিলাম।
রাইনা বলল, "তুমি এতদিন আসোনি কেন মামা?"
প্রতিউত্তর না করে আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে আদর করলাম।
নিলুপা বলল, "বিয়ে হলেই কী বোন পর হয়ে যায়?এত বড় একটা ঘটনা ঘটল একবার ও খোঁজ নিলি না ?"
দুলু ভাই বলল, "কোন ঘটনার কথা বলছ নিলু?"
নিলুপা মুহুর্তে চুপসে গেল।
আড় চোখে দেখলাম ভয়ার্ত চেহারায় ও একবার ঢোক গিলছে।
দুলু ভাই সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল," লিটু অনেক দিন পরে এসেছে, ফাও প্যাঁচাল না পেরে একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা কর গিয়ে.."
নিলুপা ভিতরে চলে গেল।
দুলু ভাই সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, "তা কেমন চলছে তোমার লেখাপড়া?"
"চলছে।"
"মাস্টার্স পরীক্ষার আর কতদিন আছে?"
"মাস খানেকের মত।"
" একেবারে নক এট দ্যা ডোর। এত কাছে? তাহলে তো ফালতু সময় নষ্ট করা একদম উচিৎ না। কি বলো ঠিক বলছি না?"
রাগের গলায় বললাম, "ফালতু সময় নষ্ট করি না।"
"ফালতু সময় নষ্ট করিনা কথাটা একদম ঠিক না। ফালতু কাজেই আমরা বেশি সময় নষ্ট করি। এই ধরো পরীক্ষার ঝামেলা নিয়েও তুমি আমাদের সাথে দেখা করতে আসছ, একচুয়েলি তুমি আমার খোঁজ খবর নিতে আসছ-- কী ঠিক বলছি না?" বলেই উনি অট্রহাসি হাসলেন।
আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল।
মনে মনে বললাম, ঠিকই বলেছিস।তোর মত পাপীর ক্ষোমা দেখতেই আসছি।
টেবিলে রাখা দৈনিক পত্রিকা ভাজ করতে করতে বললেন,
"শালার আজকাল পত্রিকা পড়লে না মাথাটা গরম হয়ে যায়। পত্রিকা খুললেই দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে, আগামী কয়েক বছরে দেশ উন্নত দেশের কাঁতারে চলে যাবে, সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যাবে এসব শুনতে শুনতে না কান ঝাঁলাপালা হয়ে গেল। আরে বাবা উন্নত দেশ হতে হলে রুচির ও পরিবর্তন হতে হবে। কালচারেও পরিবর্তন আসতে হবে। আর আমাদেরও এসবে ইউজড টু হতে হবে। ধরো কথার কথা-- এমন অনেক বিষয় আছে আমাদের দেশে ক্রাইম, কিন্তু উন্নত দেশে সেটা মোটেই ক্রাইম না। এই ধরো ড্রিংক করা, বারে যাওয়া এটসেট্রা এটসেট্রা..
আমি মনে মনে বললাম, তুই একটা খবিশ।
দম নিতে উনি একবার থামেন।
তারপর হটাত সিঙ্গেল দুই শোফার মাঝখান থেকে লম্বা মতো একটা বোতল বের করে আনেন ।
"হুইস্কি। খাবে নাকি একটু?" হেসে বললেন।
মুহুর্তে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, "আমি ওসব খাই না।"
টি টেবিলের উপর ছোট গ্লাসটায় হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বললেন, "আমিও খুব একটা খাইনা। তবে মাঝেমাঝে জীবন খুব বোরিং লাগে। একদম ব্লাক এন্ড হোয়াইট টিভির মত। জীবনকে কালারফুল করতে মাঝে মাঝে এক আধটু খেতে হয় আরকি।" বলেই গ্লাসে চুমুক দিলেন।
আমি গাড়লের মতো তাকিয়ে থাকি।
দুলু ভাই ঢকঢক করে গ্লাসের হুইস্কি টুকু শেষ করে লম্বা একটা ঢেঁকুর তুললেন ।
ধাতস্থ হয়ে বললেন, "রিয়েলি লাইফ ইজ ভেরি.. বিউটিফুল। কি যেন বলছিলাম?..ও হ্যা মনে পড়েছে, মিডিয়ার কথা বলছিলাম.. আর হ্যা মিডিয়াতে কাজ করে সাংবাদিক বা সাংঘাতিক কী একটা শ্রেণি আছে না যাদের কাজই হচ্ছে কে কোথায় ঝেঁড়ে কাশলো, কাঁশতে গিয়ে কে কোথায় বায়ু ত্যাগ করে ফেলল, যত্তসব ফালতু নিউজ। কেনরে ভাই দেশে কী আর নিউজ নাই? নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ঘোড়ার রেসের মত দৌড়াচ্ছে সেগুলো নিউজ করার সাহস নেই?..এই শালাদের বউ,বোনদের কাছে পেলে না ইচ্ছে মত আদর করে ছেড়ে দিতাম।"
বলেই জানলা দিয়ে এক দলা থুতু ফেলল।
আমি মনে মনে বললাম," তুইও একটা খাটাশ । এত বড় একটা কেলেঙ্কারির পর কোথায় একটু অনুতপ্ত হবে, লজ্জিত হবে, তা না বড় বড় কথা!
হটাত দুলু ভাইয়ের জরুরী একটা ফোন আসলো। ফোন রেখে বলল, "ভাল কথা তুমি কিন্তু রাতে না খেয়ে যাবে না লিটু। আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি।"
..
দুলু ভাই বেরিয়ে যেতেই নিলুপা আমাকে জোর করে তার ঘরে নিয়ে গেল।
"দাঁড়া তোকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি।"
বলেই তিন পার্টের আলমিরার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন করছিল। হটাত আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে ঘুরে দাঁড়াল।
বলল, "দেখতো নাকফুলটা কেমন?"
আমি ওর নাকের দিকে তাকালাম। ছোট একটা নাকফুল ওর নাকে চিকচিক করছে।
বললাম, "সুন্দর। "
"শুধু সুন্দর?"
"না অনেক সুন্দর।"
"জানিস এটা কীসের নাকফুল ?
"না "
"ডায়মন্ডের।"
"ও আচ্ছ।"
"দাম কত জানিস?"
"না।"
" চৌদ্দ হাজার টাকা।"
"কে দিয়েছে? "
"তোর দুলাভাই ছাড়া আর কে দিবে? অনেক দিন থেকেই ডায়মন্ডের একটা নাকফুলের জন্য পীড়াপীড়ি করছিলাম। দিব দিচ্ছি বলে অনেক দিন ঘুরাচ্ছিল। শেষে গতকাল কিনে দিল। যাই বলিস তোর ভাই কিন্তু মানুষ হিসেবে খারাপ না।"
আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
নিলুপা বলল, "কী দেখছিস?"
"আচ্ছা আপু তুই এত বোকা কেন বলতো?"
"ওমা! আমি আবার কী করলাম ?"
একটু থেমে বলল, "থাক ভাই আমার বোকা থাকাই ভাল। তোদের মত চালাক হতে চাই না।তোর ভাইয়া কী বলে জানিস?" বলে.. হাউস ওয়াইফ হিসেবে বোকা মেয়েরাই নাকি সবচেয়ে ভাল।"
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। এত বড় একটা কেলেঙ্কারি ঢাকতে সামান্য এই নাকফুল। আর আমার সহজ সরল বোনটা কিছুই বুঝতে পারছে না।
ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাচ্ছিল নিলুপা।
একবার গান থামিয়ে বলল, "ইশ্ তোর বিয়েটা যদি তাড়াতাড়ি হতো কি মজাই না হতো!"
বিরক্তি নিয়ে ডাকলাম," নিলুপা "
"কী?"
"একটা কথা বলবো ?"
"কী কথা?"
"এদিকে আয় ।"
নিলুপা হাসিমুখে আমার পাশে খাটে এসে বসলো।
"বল কী বলবি?"
"শোন--একটা চরিত্রহীন মানুষের সাথে এভাবে সংসার করা যায় না।"
নিলুপা বলল, "বাদ দে। পুরুষ মানুষ, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটা খারাপ কাজ করে ফেলেছে। স্যরি ও বলেছে, এরপর কী থাকে বল?"
উষ্মা চেঁপে বললাম, "শোনো আর যাই হোক একজন চরিত্রহীন, মাতাল, লুচ্চা-বদমাশ লোকের সাথে দীর্ঘ দিন সংসার করা যায় না। তুমি বরং দুলু ভাইকে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসো।
"কী বললি তুই? কী বললি? নিলুপা ক্ষেপে গেল।
বললাম "আমরাই তোমার সব দায়-দায়িত্ব নিব।"
"আর একটা কথাও বলবি না তুই। তোরা কী ভাবিস, আমি কিছুই বুঝি না? তোরা তলে তলে আমার সংসারটা ভাঙ্গার মতলবে আছিস তাই না? " বলতে বলতে আপা কেঁদে ফেলল।
সান্ত্বনা দিতে বললাম, "আমরা তোমার ভালোর জন্য বলছি।"
নিলুপা ভয়ানক চিৎকার করে উঠল।
"আমার এত ভালোর দরকার নাই। তুই এক্ষণ এই মুহুর্তে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি, আর কক্ষনো এখানে কেউ আসবি না। আমি তোদের কাউকে দেখতে চাইনা। কাউকে না..
নিলুপার ভয়ানক চিৎকারে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম। রাস্তায় নিয়ন বাতির আলোতে ফুরফুরে বাতাশ বইছে । আমি হাঁটছিলাম। অনেকটা গন্তব্যহীন হাঁটা।
মনে মনে ভাবছিলাম, হায় আল্লাহ এত কিছুর পরেও যে মেয়ে তার স্বামীকে ভালবাসতে পারে তুমি ওর ভালবাসার প্রতিদান দিও। বাকী জীবন তুমি ওকে ভাল রেখ।
দাম্পত্য জীবন আছে কিন্তু ভালবাসা নেই, পৃথিবীতে এমন পরিবারের অভাব নেই। বাল-বাচ্চা আর বাবার অসহায়ত্বের কথা ভেবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কত মেয়ে যে নীরবে জীবন পার করে দিচ্ছে, আমরা কয়জন সেই খবর রাখি!
# নাকফুল
@ মেহেরাব মাশুক
Comments
Post a Comment