ধীরে ধীরে ভালোবাসা!
- " শুভ ভাই! রাস্তা ছাড়েন। মানুষ দেখলে সমস্যা আছে। তামাশা কইরেন না। রাতে ছাদে এসেন। তখন কথা হবে। "
শুভ অব্দি ভালো ছিলো। কিন্তু ভাই শব্দটাই মেনে নিতে পারছে না শুভ । এতো বছর ভালবাসার পর বলে কি না ভাই ? প্রচণ্ড রাগে তিথির বাম হাতটা ধরে এক টানে দেয়ালের পাশে নিয়ে এসে তিথিকে বলে , " ভাই ? দু'বছর ধরে তোমাকে ভালবাসার পর তুমি কি না আমারে ভাই ডাকলা ? "
-" আপনি আমার কতো বড় ? ভাই ডাকবো না তো কি ডাকবো ? "
কতো বড় মাপার জন্যই শুভ গিয়ে তিথির পাশে দাঁড়ায়। তিথির মাথাটা শুভর কানের উপর পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। কান থেকে মাথাটা মেপে শুভ উত্তরে বলে, " বেশী না। চার আঙুল বড়। "
শুভর উত্তর শুনে তিথি নিজের মাথায় নিজেই হাত দিয়ে আলতো আঘাত করে বলে, " হায়রে কপাল! কোন গাধাকে যে ভালবাসি। এই আপনার বয়স কতো ? "
-" চব্বিশ।"
-" আমার বিশ। আপনি আমার চেয়ে চার বছরের বড়। "
-" মাত্র চার। ব্যপার না বিয়ের পর এডজাস্ট করে নেবো। "
-" আমি বিয়ে করবো না। "
-" মানে কি ? "
তিথি কিছু বলে না। শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরম মমতায় শুভর অগোছালো চুলগুলো ছুঁয়ে বলে, " আমার উপর পরিবারের অনেক প্রেশার আছে। তাছাড়া আমি বাড়ীর বড় মেয়ে। অনেক দায়িত্ব আছে আমার। ছোট ভাই দু'টোকে মানুষ করা। ছোট বোনের বিয়ে দেয়া। আপনাকে ভালো তো বাসি। কিন্তু ভালবাসাটা দিতে পারবো না। "
তিথির কথা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে না শুভ। শুভর হিসেব হচ্ছে ভালো যেহেতু বাসো ; তবে বিয়ে থা করে সংসার করো। ভালবাসো ; বিয়ে করবে না - এসব সমীকরণ অংকে কাচা শুভর মাথার উপর দিয়ে যায়।
রেগে গিয়ে বলে, " সাফ সিধা বললেই পারো। তোমার সাথে দেখা না করতে। বিরক্ত না করতে। আর কখনো তোমার পথ আগলে দাঁড়াবো না। ভালবাসি। ভালো থেকো। " কথাগুলোই বলে শুভ হনহন করে হেটে চলে যায়। তিথিকে পেছন থেকে ডাকতে থাকে -" শুভ ভাই! শুভ ভাই! " শুভ কোন উত্তর দেয় না। কেনই বা উত্তর দিবে ? দু'বছর ধরে ভালবাসার পর কেই বা চায় ভালবাসার মানুষটার ভাই হতে ?
২.
এশার আজানের শব্দ কানে যেতেই তিথির বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠে। রান্নাঘরের কাজ কর্ম সব মা কে বুঝিয়ে দিয়ে ছাদে চলে আসে। পাশের বাসাটাই শুভদের। দু'জনার একান্ত কিছুটা সময় কাটানোর একমাত্র নিরাপদ জায়গা হচ্ছে এই ছাদ।
কতোটা সময় ধরে ছাদে দাঁড়িয়ে শুভর অপেক্ষায় করছে তিথি ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না। তবে ত্রিশ মিনিটের কম নয়। শুভ তো কখনো দেরী করে না। বরঞ্চ দু'চার মিনিট আগেই আসে।
তিথি হাটলে কখনো জুতো থেকে বিরক্তিকর শব্দ হয় না। আর ছাদে আসলে তো আসবে খালি পায়ে। তবু কিভাবে যেন শুভ বাতাসে নাক গুঁজে বুঝে যেতো তিথি এসে পরেছে। তিথির খুব ইচ্ছে ছিলো পেছন থেকে এসে শুভকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু তা আর হলো না কোনদিন।
শহরের রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। কিন্তু শুভ তবুও আসছে না। আর কতো অপেক্ষা করবে তিথি ? আর কিছুক্ষণ থাকলে তিথির মা তিথিকে খুঁজতে ছাদে এসে পরবে। হতাশ হয়ে ঘরে ফিরে যায় তিথি।
৩.
কলেজের জন্য তিথিকে ডাকতে এসে পূজা জানতে পারে তিথি আজ কলেজে যাবে না। পূজা সম্পর্কে শুভর খালাতো বোন ; আবার তিথির ক্লাশমেট । বেচারা শুভ তো তিথিকে ভালবেসে মনে মনেই মনকলা খাচ্ছিলো। পরিণতি তো পূজার হাত ধরেই।
শরীর খারাপ নাকি তিথির ? আর যাই হোক প্রিয় বান্ধবী তাই তিথির রুমে যায় পূজা কি হয়েছে জানার জন্য।
অঘোরে কাঁদছে তিথি। ঠিক বাচ্চাদের মতো। একদিক দিয়ে চোখ থেকে লোনা জল ঝরছে। অন্যদিকে নাক থেকেও খানিকটা লোনা জলই ঝরছে।
পূজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, " এই তোর কি হয়েছে ? তুই কাঁদছিস কেন বাচ্চাদের মতো ? "
পূজাকে জড়িয়ে ধরে পূজার জামায় চোখের জল আর নাকের জল মুছতে মুছতে সবিস্তারে সব কিছু বর্ণনা করে গেলো তিথি।
৪.
বিকেলে বারান্দায় বসে বসে শুভ ভাবছিলো আকাশের রঙ নীল হলে আকাশী রঙ কোনটা ? শুভর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় পূজা।
চোখ জোড়া বড় বড় করে চেয়ে থাকে শুভর দিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ জিজ্ঞেস করে, " কি হইছে ? তাকিয়ে আছিস কেন ? "
-" তিথিরে কি বলছো ? বসে বসে কাঁদছে। "
শুভ কি জানি ভাবলো। তারপর বললো, " বিছানার উপর আমার মানিব্যাগটা রয়েছে। এনে দেতো। "
-" কেন ? "
-" আগে আনতো। "
পূজা এক দৌড়ে মানিব্যাগটা নিয়ে আসে। শুভ মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার একটা বৃদ্ধ নোট বের করে পূজাকে দিয়ে বলে, " তিথিকে একটা পকেট টিস্যু কিনে দিস। আর বলিস শুয়ে শুয়েও কাঁদা যায়। "
এমন কথা শোনার পর টাকাটা শুভর মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে ক্ষান্ত হলো না পূজা। শুভর চুল ধরে জোরেশোরে টানাটানি করে বেশ কিছু চুল ছিড়লো। শুভর শার্টের কলার ধরে টানাটানি করলো। টানতে টানতে ছিড়েই ফেলো। একগাদা অভিশাপ দিতে দিতে চলে গেলো।
মেয়েরা কেমন যেন ? ২০১৮ তে এসেও মেয়েদের মারামারির হাল বদলায় নি । এখনো ছোটলোকদের মতো চুল ধরে টানাটানি ; জামা ধরে টানাটানি করে। কিছুদিন আগেও কয়েকটা মেয়ে মিলে একটা মেয়েকে ধরে এভাবেই চুল আর জামা টেনে ছিঁড়েছিলো। শাড়ী ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ আর এখন জিন্স- শুধু খোলসটা পালটেছে আর কিছু নয়।
৫. " ঘেউঘেউ ঘেউঘেউ ঘেউঘেউ " - ছাদ থেকে ভেসে আসা কুকুরের আওয়াজ শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন তিথির মা। প্রায় প্রায়ই ছাদ থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসে। কিন্তু ছাদে কুকুর কিভাবে গেলো ?
তিথিকে চেঁচিয়ে বলেন, " এই দেখতো ছাদে কুকুর কি করে ? "
তিথি কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে থাকে। কুকুরকে প্রচণ্ড ভয় পায় তিথি। তবে এই কুকুরটার জন্য তিথি অপেক্ষায় ছিলো।
একদিন শুভকে বলেছিলো, " দিনের বেলা ছাদে এসে পাখির মতো ডাকবে। " বেচারা শুভ ছাদে আসার পর বুঝতে পারে তার দ্বারা পাখির ডাক দেয়া সম্ভব নয়। না পেরে শুভ বিড়ালের ডাক দেয়। কিন্তু ক্ষীণ কণ্ঠে ম্যাও ম্যাও আওয়াজ তিথির রুমে আর যায় না। তাই না পেরে ঘেউঘেউ শুরু করে দেয়। আর সেই থেকে তিথির মায়ের বাসার ছাদে দিনের বেলা কুকুর আসে।
৬.
ছাদে উঠতেই দেখে শুভ দুই হাত মুখের কাছে নিয়ে ঘেউঘেউ করছে। তিথি সামনে এসে দাঁড়াতেই শুভ বলে, " ঘেউঘেউ। "
-" কিহ ? "
-" স্যরি। তুমি কাঁদছো কেন ? "
-" তাতে তোমার কি ? "
-" তিথি জানো ? "
-" কি ? "
-" কিছু না। "
-" বলো। "
-" ভালবাসি। "
-" তুমি অন্যকিছু বলতে চেয়েছিলে। "
-" উহু। এটাই। "
-" হুহ। লাগবে না তোমার ভালবাসা। "
-" আরে বাবা স্যরি। এখন থেকে রোজ রাতে ছাদে আসবো। তুমি বললে ছাদ কেন তোমার রুমেও.....
কথা শেষ করতে পারে না শুভ। তিথি চোখ পাকিয়ে তাকাতেই শুভ চুপ হয়ে যায়। খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে ছ্যাঁত করে আবার কেঁদে উঠে তিথি। শুভকে জড়িয়ে ধরে শুভর শার্টে নাক ঘষতে ঘষতে বলে, " দূরে থেকে ভালবাসা যায় না ? বিয়ে করতেই হয় ?"
শুভ হাসতে হাসতে বলে, " আচ্ছা বিয়ে করতে হবে না। কিন্তু শার্টে নাকের জল মুছো না। মাত্রই আয়রন করে পড়েছি। "
এমন সময় নিচ থেকে তিথির মায়ের আওয়াজ ভেসে আছে। শুভর বুক থেকে নিজেকে সড়িয়ে বলে, " এই আমি যাই। নয়তো মা ছাদে এসে পরবে। রাতে ছাদে এসো। তখন কথা হবে। "
দৌড়ে চলে যাচ্ছে তিথি। শুভ পেছন থেকে আবার ডাকে তিথিকে। তিথি ফিরে তাকাতেই শুভ বলে, " তিথি জানো ? "
-" কিহ ? "
-" তুমি কিন্তু ভাইয়া ডাকছো না। তুমি আমাকে তুমি করে বলছো। "
তিথি শুধু মুচকি হাসে শুভর কথা শুনে। চলে যাবার আগে বেশ জোরেশোরেই বলে যায় -" ভালবাসি। "
Comments
Post a Comment