একটি অমানুষ!
আমার পেটের এই সাড়ে আটমাসের বাচ্চার কারনে যদি তুমি আমাকে দুর্বল, অসহায় ভাব তাহলে তুমি ভুল ভাবছো আসিফ। আমার জন্য আমার বাবা,ভাই এখনো বেচে আছে কিন্তু তোমার জন্য কেউ নেই এটা একদম ভুলে যেও না, মারিয়ার মুখ থেকে এমন কথা কখনো শুনব সেটা কল্পনাও করিনি। মেজাজ বিগড়ে গিয়ে ওর মুখে পাচ আঙুল বসিয়ে দিয়ে রুম থেকে হনহন করে বেরিয়ে আসলাম। এই মেয়ের খুব বাড় বেড়েছে আর ইদানীং তো নিজেকে সর্বসেরা ভাবতে শুরু করেছে অথচ এই কয়েক মাস আগেও সে আমার মুখে মুখে কথা বলা তো দূরে থাক আমার সামনে উচ্চস্বরে কথা বলার কথাটা সে চিন্তাতেও আনেনি। এইদিকে খুব খিদে পেয়েছে, বউ পেট উঁচু করে যত ঝামেলা আমার বাধিয়েছে, এখন তো রান্না ও করতে পারেনা আর এদিকে কাজের লোকটার নাকি জ্বর। বোঝ ঠ্যালা কেমন লাগে! বারবার মারিয়াকে বলেছিলাম এখন বাচ্চাকাচ্চার দরকার নেই কিন্তু সে জিদ চেপে এই বাচ্চাটা নিল। আমি অবশ্য বাচ্চাকাচ্চা নিতে চাইনি তা নয়, চেয়েছিলাম কিন্তু দুই তিন বছর পর। যেদিন সে বলেছিল -আসিফ আমি কনসিভ করেছি সেদিন ই আমি বলেছিলাম এটা ফেলে দাও কিন্তু সে কত ঝগড়া করল,কত কিছু হল তারপরেও বাচ্চাটা ফেলল না। তারপর রাগে,জিদে এই নিয়ে আর একটা কথাও তাকে বলেনি, চেক আপের টাকা লাগবে, এই মেডিসিন লাগবে এটা লাগবে ওটা লাগবে বললে টাকাটা হাতে ধরিয়ে দিতাম ঐসব ব্যাপারে এক মুহুর্তের জন্যও মাথা ঘামাতাম না। হোটেলে খেতে বসেছি -গরুর কালো ভুনা,খিচুড়ি, আচার আর সালাদ দিয়ে, তৃপ্তি নিয়ে অনেকদিন পর খেলাম, আহ!!, খাবার শেষ করতে করতেই টুম্পার ফোন আসল, টুম্পা আমার কলিগ- সে আমাকে তার বাসায় ডেকেছে। অফিসের কাজে বা কোন প্রোজেক্টে বস আমাকে আর টুম্পাকে প্রায় বিভিন্ন জায়গায় পাঠান। কাজের খাতিরে দিনের বেশিরভাগ সময় ই তার সাথে থাকতে হয় আমার,কাজের কথা যেমন হয় তেমনি দুজনার পছন্দ অপছন্দ, ফ্যান্টাসি, ভাবনা, ভাল লাগা এসব নিয়ে যে কম কথা হয় তা কিন্তু না। এই মেয়েটা খুব বন্ধুত্বপূর্ণ আর ওর সাথে কথা বলেও আনন্দ পাই। প্রোজেক্টের কাজে কখনো সিলেট, কখনো চিটাগাং কিংবা দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় এর পিছনে দুজনের কাজের প্রতি বসের ভাল লাগা কাজ করে। আমাদের উপর কাজ দিয়ে বস চিন্তাহীন থাকেন আর তাছাড়া আমাদের কাজের রেজাল্ট ও খুব ভাল। এইতো কিছুদিন আগে আমরা যখন কক্সবাজার যায় তখন সি বিচেও গিয়েছিলাম একটু ঘুরে আসতে আর সেই ছবিগুলো যখন ফেসবুকে আসে তখন ই মারিয়ে এটা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে দেয় আসলে আমরা যে খুব ভাল বন্ধুর চেয়ে আর বেশি কিছু নয় সেটা তাকে বোঝাতে পারিনা, আমাদের সম্বোধনটা আপনি থেকে এক ধাক্কায় তুমিতে নেমে এসেছে আর সেটা যখন মারিয়া দেখল ফোনে আমি আমার কলিগকে তুমি বলে সম্বোধন করি তখন ই সে দ্বিতীয় দফায় আরেকবার ঝগড়া করতে আসল কিন্তু আমার রক্তচক্ষু আর বিচক্ষন ব্যাখার কাছে সে অসহায় হয়ে গেল তারপর নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে দরজা আটকে খানিক্ষন চিৎকার করে কেঁদে নিল। আমি অবশ্য এসব ন্যাকামিতে মাথা ঘামাই না যা করার করুক সে। সেদিন তো স্টেডিয়ামে গিয়ে তাকে নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য কত কান্ড করল শুধুমাত্র টুম্পাকে নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাচ্ছিলাম বলে, এই উঁচু পেট নিয়ে কোথায় নিয়ে যাবো তাকে! এই কথা তাকে বোঝাতেই পারলাম না! আর রাতে তো তার যন্ত্রণায় টুম্পার সাথে ভাল করে কথাও বলতে পারিনা,সে বলে রাত ১২-১ টা পর্যন্ত অফিসের কি এত কাজ থাকে প্রতিদিন, হ্যা! প্রতিটা রাতেই কি তোমাদের কথা বলতে হবে! অফিসে তো যথেষ্ট সময় পাও, মারিয়ার এসব ঘ্যান ঘ্যান আমার একদম ভাল লাগেনা আমার। চুপচাপ ছাদে চলে যায় রুম লক করে নাহলে সে ঘ্যান ঘ্যান করবে ভদ্র লোক বলে কথা পাছে কেউ যদি শোনে হাজব্যান্ড ওয়াইফ ঝগড়া করছে তাই আমি শান্তি খুঁজতে আর সবাইকে শান্তিতে রাখতে ছাদে চলে যায়। টুম্পার বাসার সামনে নামলাম রিক্সা থেকে, টুম্পা বেলকনি থেকে আমাকে হাত নাড়িয়ে উপরে যেতে বলল। রুমে ঢুকে তো আমি অবাক হলাম!! আহ...কি সুন্দর করে রুমটা সাজিয়েছে সে, আজ আমার জন্মদিন অথচ আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম!! টুম্পা নানা ধরনের রান্না করেছে, খুব সুন্দর একটা কেক এনেছে। দুজনে গল্প করতে করতে রাত ১১ টা বেজে গেল! তবুও যেন গল্প শেষ হয়না!কেক কেটে সে আমাকে খাইয়ে দিল আর আমিও তাকে খাইয়ে দিলাম,কেক সারা গায়ে মাখামাখি করে অনেকগুলো সেল্ফি তুললাম সে খুব ক্লোজ হয়ে ছবি তুলেছিল, একটাই তো দিন তাই আর মানা করিনি আর আমার তাকে মানা করার সাহস ও ছিল না, টুম্পা রেজালাটা দারুন বানিয়েছিল, পেট পুরে খেয়ে বাসায় ফিরলাম। ভেবেছিলাম মারিয়া চলে গেছে, কিন্তু না সে যায়নি! টেবিলের উপর দেখলাম অনেক পদের রান্না করা আর একটা দুই পাউন্ডের কেক তাতে লেখা :- Happy birthday sweetheart
ধুর যত্তসব ন্যাকামি, সারাদিন জ্বালিয়ে এখন আসছে পিরীত করতে। রুমে যেয়ে কাপড় চেইঞ্জ করে বিছানায় বসলাম, মারিয়া গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল :- তোমার আর টুম্পার বার্থডে ছবিতে প্রায় সতেরশো লাইক! মোবাইলটা আমার দিকে দেখিয়ে বলল দেখো টুম্পার মুখটা তোমার মুখের সাথে কিভাবে লেগে আছে! একটুও লজ্জা লাগেনা আসিফ! একটুও না!!?? ধুর এ সমস্ত আজাইরা জিনিস নিয়ে কেন পড়ছো তুমি! আমরা ভাল বন্ধু এর চেয়ে বেশি কিছুনা আর হ্যা, কাজের খাতিরে আমাদের এক সাথে সময় কাটাতে হয় এটাও তোমার বুঝতে হবে। এবার মারিয়া অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল- এই জাস্ট ফ্রেন্ড বলে বলেই তো এই মেয়ের সাথে সি বিচে ঘুরে বেড়াও, তাকে খাইয়ে দাও..ক্লোজ ছবি তুলে সেগুলো ফেসবুকে আপ্লোড কর তাই না?? এই জাস্ট ফ্রেন্ডের আর কত আ্যডভেন্টেজ নিবা আসিফ? আর কত? নাকি তার পেটেও বাচ্চা দিয়ে বলবা -উই আর জাস্ট ফ্রেন্ড নট মোর দ্যান! মারিয়া একদম বাজে কথা বলবানা খবরদার..খুব খারাপ হবে খুব! মারিয়া বলে উঠল - এই তুই কি খারাপ করবি?? তোরে তো আজ আমি মেরে ফেলব..এই বলেই মারিয়া আমার দিকে তেড়ে আসল এসে শার্টের কলার ধরে ধস্তা ধস্তি শুরু করল এক পর্যায়ে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম। মারিয়া মা....গো বলে দাপাতে দাপাতে জ্ঞান হারালো। আমি খানিকটা ভয়ে পেয়ে গেলাম- হাসপাতালে নেয়া হলে জানা গেল বাচ্চা পেটেই মারা গেছে। এবার আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলাম।
আমি এবার কাঁদতে লাগলাম কিন্তু কেন কাঁদছি এটা জানিনা শুধু এটাই জানি আমাকে অনেক বেশি কাঁদতে হবে আজ অনেক বেশিই কাঁদতে হবে। মারিয়া তার বাবার বাড়ি চলে গেছে, আমার নামে মামলা হয়, পত্রিকাতে খুব চড়াও করে এই খবর ছাপানো হয়, কোম্পানির সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে আমাকে তারা চাকুরী থেকে বহিষ্কার করে। আজ দেড়মাস ধরে জেলে আছি কেউ একটাবার আমাকে দেখতে আসেনি ভেবেছিলাম টুম্পা অবশ্যই আসবে, জেলের এক পুলিশকে টাকা দিয়ে টুম্পাকে ফোন করেছিলাম সে আমার ভয়েস শুনেই কল কেটে দিয়েছেপ কয়েকবার চেস্টা করেও লাভ হয়নি। এই জেলে সারাদিন শুয়ে বসে অনেক কিছুই ভাবি। এখন বুঝতে পারছি মারিয়ার প্রতি কি অবিচারটাই না আমি করেছি! সে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় থাকাকালীন আমি তার গায়ে হাত তুলেছি,সে না খেয়ে থাকার পরেও তাকে খাবার কথা বলিনি। তাকে দেখিয়ে আমি অন্য একটা মেয়ের সাথে বেলাল্লাপনা করে বেড়িয়েছি। নিজেকে মারিয়ার জায়গায় কল্পনা করে দেখলেই গা শিহরে ওঠে আমার! কত বড় অমানুষ ছিলাম আমি! আজ আমার বউটা যদি তার কলিগের সাথে ঠিক এমনটাই করত তাহলে কি আমি মেনে নিতাম! মোটেও না উলটো তাকে এর জন্য অনেক খেসারত দিতে হত। তাকে ডিভোর্স ও দিয়ে দিতাম হয়তো যেমনটা পান থেকে চুন খসলেই এই জেনারেশনের ছেলে মেয়ে ব্রেক-আপ করে ঠিক তেমন করেই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতাম যদি সে এমন কিছু করত। একটা মেয়ে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় নানা ভয়ে থাকে, নিজেকে অসহায় ভাবে, তখন সে চায় কেউ তার সেবা করুক, তার পেটে চুমু খাক। সে না খেলেও তাকে জোর করে খাইয়ে দিক আর আমি!! কি করেছিলাম আমার মারিয়ার সাথে!! আর আমার সন্তান! তাকে তো নিজেই হত্যা করলাম। নাহ! এই শাস্তি আমার জন্য যথেষ্ট না একদম যথেষ্ট না। দেখতে দেখতে সাড়ে আট মাস চলে গেল। রাতে ঘুমাবার আগে এক পুলিশকে দিয়ে একটা ব্লেড আনিয়ে রেখেছি নখ কাটার অজুহাতে। সকালে উঠে সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেই আজ নিজের গলা কেটে ফেলব, আমার পাপের শাস্তি তো আমাক পেতেই হবে। আমি যে খুনী..এই সামান্য শাস্তি আমার জন্য যথেষ্ট না, আমি এক সাথে দুটো জীবনকে হত্যা করেছি এক আমার মারিয়াকে দুই আমার সন্তানকে। জীবনের শেষ খাবারটা নিয়ে বসে আছি কিন্তু শেষ বেলায় এসে এই শক্ত রুটিকে পাথরের মত লাগল, গিলতে পারছিলাম না বাধ্য হয়েই রুটি থালাটা সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়লাম, শেষ বেলায় এসে মারিয়ার মুখটা চোখে ভাসছে আর চোখ তো আনন্দে কেঁদে চলেছে -আজ আমি উপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছি! এর চেয়ে বেশি কিছু আর হয়তো এই জীবনে পাবোনা। কে যেন বলে উঠলো- প্যাকেটে তোমার প্রিয় পাটি সাপ্টা রাখা আছে খেয়ে নাও। চোখ মেলেই দেখি মারিয়া! হিসেব মিলছে না.. একদম মিলছে না। একটা জানোয়ারকে একটা মেয়ে এত ভাল বাসে কিভাবে!!?
Comments
Post a Comment