একটু একটু ভালোবাসা
মায়িশা আমার হাত ধরে টানতে টানতে আজহার ভাইয়ের বাসা থেকে বের করে দরজার সামনে এনে একটু জোরেই বললো “জাহেদ তুমি অফিসের কাজে ঢাকায় গিয়েছো তাই নাহ?” আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। ইতি মধ্যে অনেক কথা বলে ফেলেছে আমাকে। যা আমি নিস্তব্দ হয়ে হজম করেছি। আজহার ভাই চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একবার আজহার ভাই এর দিকে তাকাই আর একবার মায়িশার দিকে তাকাই। আমার মনের ভিতর যে সুর বয়ে চলে তা আমি কখনো প্রকাশ করি না। কেন যেন করতে ইচ্ছে করে না। আমি মানুষটা সাদা সিধে হলেও নিজের প্রিয় মানুষ গুলোর সাথে একটা তৃপ্তি মাখা চেহারায় কথা বলতে ইচ্ছে করে। আমার এই কথা বলার সম্ভাবনাটা অনেক মানুষ পছন্দ করে আবার অনেকে করে না। তবু এই আমি আমাকে মিলিয়ে এই শহরের নিক্রোপলিশে দিব্বি নিশ্বাস নিচ্ছি। প্রিয় পাঠক হয়তো একটু কঠিন করে বলে ফেলেছি। তবে আপনারা যা ভাবছেন আমি মানুষটা মোটেও এমন না। অনেকটা মিচকা শয়তানের মত বলা চলে। এটা আমার কথা না। এটা মায়িশার কথা। সে আমাকে মিচকা শয়তান মনে করে। বিশিষ্ট লেখক হুমায়ূন আহমেদ অনেক উক্তি করে গিয়েছে। অবশ্য তার লেখা আমি কখনো পড়িনি। অবাক হলেও হতে পারেন তবে এটা সত্য। তার উক্তির মধ্যে একটা উক্তি ছিলো “ভালো মানুষের রাগ থাকে বেশি। যারা মিচকা শয়তান তারা রাগে না। পাছায় লাথি মারলেও লাথি খেয়ে হাসবে।”
.
আমি আজহার ভাইকে চোখ টিপ মেরে বুঝালাম “ভাই চিপায় পড়ে গেছি রক্ষা করেন” আজহার ভাই দাঁত কিড়মিড় করে এমন একটা লুক দিল যার অর্থ “তোর ঝামেলা তুই সামলা বেটা” আমার চোখ টিপ মারা দেখে মায়িশা আমার ডান হাতের বাহুতে কয়েকটা ঘুষি মেরে বললো “কি বুঝাচ্ছো তুমি? তুমি মনে করেছো আমি খেয়াল করিনি? তুমি যে একটা মিচকা শয়তান আমি ভালোই করেই জানি। আজকে বাসায় চলো তোমার এই মিচকা শয়তানি আমি বের করবো।” আমি একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে খুব শান্ত ভাবে বললাম “আসলে হয়েছে কি ঢাকায় তো গিয়েছিলাম। মিটিংটা ক্যান্সেল হয়েছে হঠাৎ করে। আমার কিছুই করার ছিল না। তোমার তো আবার আমাকে ছাড়া ঘুম আসে না। আমি গল্প বলে না শোনালে, মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে তোমার কি রাতে ঘুম আসে বলো? তাই এই কথা ভেবে সাথে সাথেই আবার রওনা দিলাম। বাসায় যখন যাচ্ছিলাম রাত আটটার সময় আজহার ভাইয়ের সাথে দেখা। আজহার ভাইও আমাকে দেখে অবাক। বললো ঢাকায় যাস নাই? আমি আজহার ভাইকে সব খুলে বললাম। আজহার ভাই অদ্ভুত ভাবে হঠাৎ বায়না করলো তার বাসায় এক কাপ চা খেয়ে যেতে। আমি না করতে পারি নাই।” এই কথা বলে আজহার ভাই এর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ টিপ মেরে বললাম “কি আজহার ভাই আমার এই কথা গুলা কি মিথ্যা? আমি কি মিথ্যা কথা বলি? আজ পর্যন্ত অফিসের কেউ বলতে পারবে আমি মিথ্যা বলেছি?” যেই আজহার ভাই কিছু বলতে যাবে আমি আবার বলতে লাগলাম “আহা তোমার কিছু বলা লাগবে না। তোমার এনার্জি নষ্ট করে কি লাভ বলো। এমনিতে তুমি সারারাত কান্না করতে করতে শেষ। চোখ দিয়ে কত এনার্জি পড়ে গেছে তোমার ধারনা আছে?” আমি মায়িশার দিকে তাকাই। ও খুব রাগ রাগ ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার তাকানোর ভঙ্গিমাটা এমন ছিল যে তোমাকে আমি আলু ভর্তা বানিয়ে খেয়ে ফেলবো। আমি আবার সেই অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললাম “আমার কথা কি বিশ্বাস হচ্ছে না? পুরোটাই তো তোমাকে এখনও বলা হয়নি। আজহার ভাই এর বাসাই গিয়ে দেখি ভাবী বাসায় নেই। ভাবী গিয়েছে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে। আজহার ভাই এর সাথে চা খেতে খেতে দেখি সে হঠাৎ করে কান্না করছে। আমি বললাম কি ভাই কান্না করেন কেন? সে বলে বউকে মিস করি। আমি কি বলবো কিছু বুঝতে পারিনা। সে যে বউ পাগলা আমি জানতামই না। বউ ছাড়া থাকতে পারে না। কিন্তু বেচারার কাধে তো অফিসের অনেক দায়িত্ব। এই দায়িত্বের কথা ভেবে সে গ্রামে বউ এর সাথে যায় নাই। আর এই কান্না থামানোর শান্তনা দিতে দিতেই একটা রাত কেটে গেছে। একটা মানুষ এতো কান্না করতে পারে কিভাবে? এই যে উনার দুইটা চোখ দেখছো এই গুলা চোখ না, এই গুলা এক একট সমুদ্র। আমি কি জানতাম এই মাথা মোটাটা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মত কান্নাকাটি করবে? একটা রাত তোমার জন্য কত কষ্ট, তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে না দিলে সেটা কি উনি বুঝবে? বুঝবে নাতো, সে তো অফিসের দায়িত্ব ছাড়া কিছু বুঝে না” এই কথা বলে আমি আজহার ভাই এর দিকে তাকাই। আজহার ভাই বড় বড় চোখ নিয়ে তাকায়। কি হচ্ছে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। আজহার ভাই অবাক হয়ে বললো “তুই এই গুলা কি বলতেছিস?” আমি আজহার ভাইকে পুনরায় চোখ টিপ মেরে হাত দিয়ে বুঝাই পরে বুঝাই বলবো ভাই এখন চুপ যান। মায়িশা কোমড়ে দু হাত রেখে জোরে জোরেই আমাকে বললো “আমার সাথে মজা করো? আমাকে বাচ্চা মনে হয় তোমার?” এই কথা বলে আবার টানতে টানতে সিড়ি দিয়ে নামতে থাকে। আমি বললাম “মোবাইলটা নিয়ে আসি ছাড়ো না। ও আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকায়। তারপর হাতটা ছেড়ে দেয়। আমি আজহার ভাই এর বাসায় ঢুকতেই “আজহার ভাই বললো “তুই আমারে নিয়ে এই গুলা বললি ক্যান? এই আমি কি বউ পাগলা? আমার চোখ দুটো সমুদ্র?” আমি মোবাইলটা নিয়ে শার্টের কলার ঠিক ঠিক করতে করতে বললাম “পৃথিবীর সব পুরুষেরাই কম হোক আর বেশি হোক বউ পাগলা বুঝছো। কেন তুমি তোমার বউকে ভালোবাসো না? আচ্ছা এইটা বলো তোমার বাসায় যে আমি আছি মায়িশা কিভাবে জানলো?” আজহার ভাই একটু ইতস্তত হয়ে বললো “তুই ওয়াশরুমে ছিলি, তোর বউ ফোন করেছিল, আমি রিসিভ করেছিলাম।” আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। আমি আজহার ভাইকে বলি তোমাকে পরে সব কিছু বলবো। রিসিভ করেই ঝামেলা পাকায় দিছো। এমনিই কি বলছি তুমি মাথা মোটা?” এই কথা বলে আমি বের হয়ে যাই।
.
এই অবিরাম আকাশটার নিচে ফাকা রাস্তায় রিকশা করে প্রিয় মায়িশা আমাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে শায়েস্তা করার জন্য। আমি চুপ করে চারপাশটায় দেখতে লাগলাম। আমার সাথে কি ঘটবে আমি এর কিছুই জানি না। ঈদ মৌসুমে এই ফাকা রাস্তাঘাটে প্রিয় মানুষের সাথে রিকশায় চড়া একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু এই অনুভূতির বিন্দু মাত্র ছোয়াও এখন আমাকে কেন যেন স্পর্শ করছে না। আমার সমস্থ কিছু কোথায় যেন থমকে গিয়েছে। পৃথিবীর সব কোলাহল যেন ঝিম মেরে আছে। এই শহরের সকালের রৌদ্রের আলো এলোমেলো বাতাস মায়িশাকে ছুয়ে দেয়। সেই ছোয়ার মাঝে তার চুল উড়তে থাকে। আমি ওর দিকে মায়া মায়া আবেগে তাকাই। কেমন একটা গম্ভীর হয়ে চুপ করে আছে। সেই গম্ভীর চেহারার চোখের মাঝে আমি জল আসার আভাস লক্ষ্য করি। আমি কি বলবো বা আমার কি বলার উচিৎ অনুধাবন করে কিছুই বুঝতে পারি না। যেই আমি হাতের আঙ্গুলের নখ দাঁত দিয়ে কাটতে যাব তখনি মায়িশা আমার হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে সামনের দিকে আবার তাকিয়ে থাকে। যেন আমার সাথে তার কত অভিমান কিংবা রাগ। কিন্তু আমার ব্যাপারে তার যথেষ্ট খেয়াল আছে। অবশ্য রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দাঁত দিয়ে নখ কাটা নিয়েই যত ঝামেলা। আমি যখন কোন কিছু নিয়ে ভাবি, বা কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করি, বা কোন কিছু নিয়ে উত্তেজিত বা চিন্তিত থাকি তখন দাঁত দিয়ে নখ কাটতে থাকি। এই অভ্যাসটা আমার ছোট বেলা থেকেই। বিয়ের পর মায়িশা এটা নিয়ে আমাকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু কোন কাজ হয়নি। যখন কাজ হলো না তখন আমাকে থেরাপি দেওয়া শুরু করলো। বাসায় আমাকে একা টেলিভিশন দেখতে দিবে না। তার ধারনা টেলিভিশনে কোন মুভি বা নিউজ দেখার সময় আমি দাঁত দিয়ে নখ কাটি। তারপর অফিসে দু ঘন্টা পর পর ফোন দিয়ে বলবে “কি করছো? দেখো কাজ নিয়ে তাড়াহুড়া করবে না। যা করবে আস্তে ধীরে করবে। তারপর দুপুরে লাঞ্চের সময় বিডিও কল দিয়ে আমার হাতরে নখ চেক করবে। রাতে খাওয়ার সময় মাঝে মাঝে নিজ হাতে খাইয়ে দিবে। আমি তাকে একবার বলেছিলাম “ভাত খাওয়ার সময় কি কেউ দাঁত দিয়ে নখ কাটে আজব?” কিন্তু সে বলেছিল এই অভ্যাসটা যতদিন ছাড়তে না পারবে ততদিন আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিব। তোমার সমস্যা আছে?” আমি আর কিছু বলিনি। বাসায় আামার হাতের মাঝে হাত মৌজা পড়িয়ে দিত। এই একটা জিনিস আমার খুব বিরক্ত লাগতো। কিন্তু তার এইসব কাজ একটাও সফল হতো না। আমার জীবনটা কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তা আমি কিছুই উপলব্দি করতে পারছিলাম না। যেন একটা স্কুলের বাচ্চাদের মত জীবনটা আবার সাজাচ্ছি। সকালে কাধে ব্যাগ ধরিয়ে দাও। অফিসে যাও। অফিস থেকে এসে তার কথা মত চলো। কত সুন্দর জীবন। কিন্তু এসব কোন ব্যাপার ছিল না। নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিলাম। আসল ব্যাপার ছিল এই যে ফুটবল বিশ্বকাপ খেলা চলছে। আমার প্রিয় দলের যখন খেলা হচ্ছিল তখন আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম। আমি মায়িশারে বললাম “দেখো গরম লাগছে। মৌজার ভিতর হাত ঘামিয়ে গিয়েছে” সে কিছু না বলাতে আমি মৌজা খুলে ফেলি। এদিকে খেলা চলছে আর আমার মনের ভিতর একটা উত্তেজনা টান টান ভাব কে জিতবে? গোল হচ্ছে না কেন? উত্তেজিত হলে আমার হাত গুলো কেমন যেন ছটফট করতে থাকে। আমি বার বার মুখে হাত দিচ্ছিলাম মায়িশাও বার বার হাত সরিয়ে দিচ্ছিল। তারপর আমার দুই হাত তার দুই হাত দিয়ে ধরে নিজের কোলে রেখেছিল। কিন্তু এই ভাবে কি খেলা দেখা যায়? কেমন একটা বন্ধি কারাগারের মত বসবাস করছি। আমি কি ইচ্ছা করেই দাঁত দিয়ে নখ কাটি? খুব বিরক্তবোধ করেছিলাম। মাথাটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাগ করিনি। ঐ যে বিশিষ্ট লেখক বলে গিয়েছেন “মিচকা শয়তানরা রাগ করে না” ভারতের কোন নায়ক যেন মা আর বউ কে তুলনা করে বলেছিল “বউ হারালে বউ পাবি কিন্তু মা হারালে মা পাবি নারে পাগলা।” কিন্তু আমি রাগ আর বউ কে তুলনা করে বলি “রাগ চলে গেলে হাজার বার রাগ করা যাবে কিন্তু বউ চলে গেলে বউ পাওয়া যাবে নারে পাগলা” সিদ্ধান্ত নিলাম খেলা এইভাবে দেখলে চলবে না। ঐদিকে আজহার ভাই থেকে জানলাম উনার বউ বাড়িতে গিয়েছে ঈদ করতে। কি যেন ভেবে আমি আজহার ভাইকে বলেছিলাম “ভাই আমারও তো একই অবস্থা। আমার বউও বাড়িতে গিয়েছে। আমার বাড়িও খালি, আপনার বাড়িও খালি। আপনার বাসায় চলে আসি? একা একা থাকতে ভালো লাগে না। তবে আজ না, যেদিন আমাদের দুজনের দলের খেলা আছে। একসাথে দুজনে মিলে দেখলাম।” আজহার ভাই রাজিও হয়েছিল। কিন্তু আজহার ভাই জানতো না আমি এই গুলা লুকিয়েছিলাম। তাই পরশু মায়িশাকে বলেছিলাম ঢাকায় যাচ্ছি অফিসের একটা কাজে। মায়িশা প্রথমে ঘ্যানর ঘ্যানর করেছিল ঈদ না যেতেই মিটিং কিসের?” আমি ওরে বললাম “অফিস থেকে পাঠালে আমি কি কররো? আমি তো চাকরি করি তাই না? যার চাকরি করি তার কথা তো শুনতে হবে। চাকরি মানেই তো বুঝো চাকর।” সে আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিল। তার তাকানো যেন বলছিল “তুমি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছো জাহেদ” সব কিছু ঠিকই ছিল। রাতটাও পার করলাম খেলা দেখে। আমার নখ তেমন নেই বললেই চলে। সব কামড়িয়ে শেষ করে দিয়েছি গতকাল খেলা দেখে। কিন্তু এই আজহার ভাই যদি ফোনটা রিসিভ না করে কথা বলতো তাহলে এমনটা আর হতো না।
.
রিকশাটা বাসার সামনে এসে থামে। আমি ভাড়া দিতেই সে আবার আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাসার ভিতর নিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। আমার ভিতর একটা ভয় এসে জমা হয়। সে কোমড়ে শাড়ির আচল গুজতেই আমি বুঝলাম যার অর্থ আজকে তোরে খাইছিরে। কিন্তু তার চোখে জল আসার উপক্রম দিব্বি আমি দেখতে পাচ্ছি। সে আমার দিকে জল আাসার উপক্রমের মায়ামায়া চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। আমিও কিছু বলি না। তার চোখে কান্নার আভাস আর শরীরে রাগ মাখানো এই দুটোর মধ্যে আমি হঠাৎ করে যেন একটা আত্মপ্রশান্তির অনুভব করলাম। যে প্রশান্তিতে আমার এই বদ্ধ ঘরে নিরবতা এসে ভর করে। আমি কিছু বলে উঠার আগেই সে আমাকে খুব গম্ভীর হয়ে বললো “আমাকে কেন মিথ্যে বললে তুমি?” আমি চুপ করে থাকি। এমন মায়া আর অভিমান মাখানো কথায় আমার শরীরের সিড় ধারায় কিছু একটা বয়ে যায়। আমি মাথা নিচু করে তাকে ইতস্তত করে বললাম “কষ্ট পেয়েছো?” সে আমার এই কথার কোন প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললো “আমি কি তোমায় খুব জ্বালাতন করি? খুব বিরক্ত করি?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইশারা দিয়ে একটু কাছে গিয়ে ওর হাতটা ধরে বললাম “এমনটা কখনই না। আমি খুব দুঃখিত।” সে আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দু কদম পিছনে গিয়ে একটু জোড়েই বললো “তাহলে কেন মিথ্যে বললে? কেন আমার থেকে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো তোমার?” তার এমন শব্দে আমার আলোর ঘরে যেন আঁধার ঢোকার দৃশ্য চোখে ভাসে। আমি খুব শান্ত ভাবেই তাকে সব কিছু খুলে বললাম। তার সেই মায়ামায়া চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি মুছে দিতেই সে বললো “আমাকে ছুবে না তুমি। অনেক স্বার্থপর তুমি। শুধু নিজেরটা ভাবলে। আমার কি একা থাকতে ভয় লাগে নাহ? আর এই যে তোমার দাঁত দিয়ে নখ না কাটার জন্য এতো কিছু করলাম কেন করেছি? কেউ যখন তোমাকে এই বিষয়টা নিয়ে মজা করে আমার কি খারাপ লাগে না?” আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। কেন যেন নিজের গালে একটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করলো। আমার কি এমনটা না করলেও হতো না? আসলেই আমার এই দাঁত দিয়ে নখ কাটার বিষয়টা নিয়ে যখন কেউ কিছু বলে মায়িশার মুখটা খুব আচ্ছন্ন হয়ে যায়। বিয়ের পরে চাকরির কারনে আমি ওকে শহরে নিয়ে আসি। কিন্তু নতুন বিয়ে বলে কথা। বিয়ের পর আত্বীয়স্বজনরা দাওয়াত দেওয়ার আমেজটা লেগেই থাকে। তার ধারাবাহিকতায় তার বড় বোনের শ্বশুর বাড়িতে ঘুরে আসার জন্য বলেছিল। ওখানে গিয়ে একটা দিন কাটানোর পর ওর বড় বোন যখন আমার এই দাঁত দিয়ে নখ কাটা বিষয়টা দেখলো তখন তিনি বললো “এই তুমি তো দেখছি একটা খবিশ। দাঁত দিয়ে নখ কাটো কেন হ্যাঁ?” আমি একটা হাসি দিয়ে বলেছিলাম “না মানে আপা ছোট বেলার অভ্যাস ছাড়তে পারি না” আর এই দৃশ্যটা মায়িশা লক্ষ্য করেছিল। ও কাছে আসতেই মায়িশাকে দেখে বড় আপা বললো “মায়িশা তোর জামাই তো একটা খবিশ।” মায়িশা আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো “আপা স্যরি বলো ওকে।” আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। বড় আপা বললো “কেনরে?” মায়িশা চুল গুলা কানে গুজে বললো “স্যরি বলতে বলেছি বলো।” আপা চোখ কপালে তুলে বললো “কিন্তু কেন? তোর জামাইকে স্যরি বলবো কেন?” মায়িশা একটু রেগে বললো “এই জন্যই বলবে তুমি আমার স্বামীকে খবিশ বলেছো। তোমার সাহস কোথা থেকে আসে খবিশ বলার? তুমি স্যরি বলবে? তুমি স্যরি না বললে এখনি তোমার বাসা থেকে বের হয়ে যাব। বলবে তুমি স্যরি?” বড় আপা ঠিকি পরে আমাকে স্যরি বলেছিল। আমি মায়িশাকে বলেছিলাম “আহা বড় আপা মশকরা করে বলেছে আরকি। এমন না করলে কি হতো না?” সে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এরপর থেকেই বড় আপা আমার সাথে সব সময় হিসেব করে কথা বলে। মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজ খবর নিয়ে বলে “আমার বোনটাকে কি এমন তাবিজ করলা তুমি হ্যাঁ? তোমাকে কেউ কিছু বললে ও ছ্যাত করে ওঠে।” আমি বলি “আপা ভালোবাসা বুঝলেন ভালোবাসা।”
.
মায়িশার কাছে এমন মিথ্যা কথা বলা মোটেও উচিৎ হয়নি আমার। অনেকটা সময় অতিক্রম হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যার আবছায়া পার হয়ে রাত আসে। সে আমার সাথে কথা বলে না। আমি নির্বাক, অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তার চারপাশে ঘুরতে থাকি। তাকে বার বার স্যরি বলতে থাকি। আমার ছোট্ট বাসার কাচের জানালা দিয়ে এই রাত্রি বেলা চাঁদের আলো এসে ওর মায়াকড়া চেহারায় চড়িয়ে পড়ে। আমি এক অদ্ভুত মনগড়া চেহারা নিয়ে তার অভিমান করা চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। মেয়েটা দুপুর বেলা থেকেই কিছুই খায়নি। আমিও কিছু খাইনি। এই ব্যাপারটা নিয়ে এমন একটা কান্ড ঘটে যাবে কে জানতো? যেন আমার ভালোবাসার বৃত্তের মাঝে হঠাৎ করেই ছোট্ট বিন্দুকনাটা আমাকে আঘাত করছে বারংবার। সে হঠাৎ করেই আমার কাছে এসে বলে “টেবিলে খাবার দিয়ে রেখেছি। কারো ক্ষিধে লাগলে যেন খেয়ে নেয়।” আমি ওর দিকে তাকালাম কিছুক্ষন। কত স্বাভাবিক ভাবেই না বলেছে কথাটা। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম “তুমি খাইয়ে না দিলে খাব না।” সে আমার দিকে সেই মায়াকড়া অভিমান চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো “কেউ যেন এমন ন্যাকামো না করে। মিচকে শয়তানি আমার একদম পছন্দ না। আমি এতো ঠেকায় পড়িনি কাউকে খাইয়ে দিব। এটা আমার চাকরি না। যার ইচ্ছা হবে সে খেয়ে নিবে।” এই কথা বলে যেই ও রুমের ভিতরে যাবে তখন আমি ওর সামনে গিয়ে কান ধরে বললাম “আবারও স্যরি। আর এমন হবে না কথা দিচ্ছি। প্লিজ খেতে চলো অনেক ক্ষুধা লেগেছে।” ও আমাকে সরিয়ে দিয়ে রুমে চলে যায়। আমি কি করবো বুঝতে পারি না। আমি নির্বাক হয়ে আমার ঘরের দেয়ালের অভিমান আর রাগকে অনুভব করি। এই রাত্রি বেলা আমার বাসার ছোট্ট জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোটাকেও কেন যেন অন্য রকম লাগছে। আমার আশ পাশের সব কিছুকেই হঠাৎ করে আলাদা মনে হয়। আলাদা মনে হয় আমার ছায়াটাকেও। কেন যেন এসব কিছুই আমার হয়েও আমার হয়না। আমার থেকে দুরে সরে যায়। আমি দেখতে পারবো, অনুভব করতে পারবো কিন্তু স্পর্শ করতে পারবো না। আধাঁরের স্পন্দন আমার শরীরে মিশে শরীরটাকে অবশ করে দেয়। আমি এখান থেকে ওখানে পায়চারি করতে থাকলাম। মনের ভিতর উত্তেজনা তৈরি হয়। চিন্তা তৈরি হয়। কি করবো বুঝে উঠতে পারিনা। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে থাকলাম। এর কয়েক মিনিট পরেই মায়িশা আবার হুট করে এসে মুখ থেকে হাত সরিয়ে রাগ রাগ ভাব নিয়ে বললো “তুমি তারপরও দাঁত দিয়ে নখ কাটতেছো? কেন করো এমনটা? আমি তার দিকে চুপ করে তাকিয়ে অনুভব করতে থাকলাম। তার এই আগমনের আলোয় আমার শরীরটা যেন ঝিম মেরে যায়। সে আবার বলতে লাগলো “আমার কি খারাপ লাগেনি? আমার সাথে কেউ মিথ্যে বললে আমি কেন যেন মেনে নিতে পারি না।” এটা বলেই সে আবার চুপ করে থাকে। আমিও চুপ করে থেকে দাঁড়িয়ে তার চোখকে বুঝার চেষ্টা করি। অন্তমিলের উষ্ণতা তার মায়াকড়া চোখে খেলা করে। সেই চোখকে আমার স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে। আমার চুপ থাকা দেখে সে আবার বললো “অনেক ক্ষুধা লাগছে তাই না? সেই কখন থেকে না খেয়ে আছো। রাগ ভাঙ্গাতেও শিখো নাই নাকি? গাধা একটা। শুধু দাঁত দিয়ে নখ কাটতে পারো। খেতে চলো।” আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে অনুভব করতে লাগলাম মেয়েটা আমাকে নিয়ে কত চিন্তা করে। সেও কিছু খায়নি কিন্তু সে আমার খাওয়া নিয়ে চিন্তা করছে। আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করেই তার সমস্থ রাগ জলাঞ্জলি দিয়ে আমার কাছে এসেছে। আমি চুপ করে তার সাথে খেতে চললাম। কিন্তু আজ আমি নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দিব। আমি নির্গাত বলতে পারি আমার জানালা দিয়ে যে চাঁদের আলোটা এসে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে সেটা যদি কোন কারনে আর না আসে আমি একটুও মন খারাপ করবো না। আমার এই ছোট্ট সংসারে মায়িশার আবছায়া আলোটা আমার ঘরের দেয়ালটায় ছড়িয়ে একটা বৃষ্টিকাব্য তৈরি করবে। আর এই বৃষ্টিকাব্যটা আমি কখনো হারাতে চাই না। একটুর জন্যও না…
.
আমি আজহার ভাইকে চোখ টিপ মেরে বুঝালাম “ভাই চিপায় পড়ে গেছি রক্ষা করেন” আজহার ভাই দাঁত কিড়মিড় করে এমন একটা লুক দিল যার অর্থ “তোর ঝামেলা তুই সামলা বেটা” আমার চোখ টিপ মারা দেখে মায়িশা আমার ডান হাতের বাহুতে কয়েকটা ঘুষি মেরে বললো “কি বুঝাচ্ছো তুমি? তুমি মনে করেছো আমি খেয়াল করিনি? তুমি যে একটা মিচকা শয়তান আমি ভালোই করেই জানি। আজকে বাসায় চলো তোমার এই মিচকা শয়তানি আমি বের করবো।” আমি একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে খুব শান্ত ভাবে বললাম “আসলে হয়েছে কি ঢাকায় তো গিয়েছিলাম। মিটিংটা ক্যান্সেল হয়েছে হঠাৎ করে। আমার কিছুই করার ছিল না। তোমার তো আবার আমাকে ছাড়া ঘুম আসে না। আমি গল্প বলে না শোনালে, মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে তোমার কি রাতে ঘুম আসে বলো? তাই এই কথা ভেবে সাথে সাথেই আবার রওনা দিলাম। বাসায় যখন যাচ্ছিলাম রাত আটটার সময় আজহার ভাইয়ের সাথে দেখা। আজহার ভাইও আমাকে দেখে অবাক। বললো ঢাকায় যাস নাই? আমি আজহার ভাইকে সব খুলে বললাম। আজহার ভাই অদ্ভুত ভাবে হঠাৎ বায়না করলো তার বাসায় এক কাপ চা খেয়ে যেতে। আমি না করতে পারি নাই।” এই কথা বলে আজহার ভাই এর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ টিপ মেরে বললাম “কি আজহার ভাই আমার এই কথা গুলা কি মিথ্যা? আমি কি মিথ্যা কথা বলি? আজ পর্যন্ত অফিসের কেউ বলতে পারবে আমি মিথ্যা বলেছি?” যেই আজহার ভাই কিছু বলতে যাবে আমি আবার বলতে লাগলাম “আহা তোমার কিছু বলা লাগবে না। তোমার এনার্জি নষ্ট করে কি লাভ বলো। এমনিতে তুমি সারারাত কান্না করতে করতে শেষ। চোখ দিয়ে কত এনার্জি পড়ে গেছে তোমার ধারনা আছে?” আমি মায়িশার দিকে তাকাই। ও খুব রাগ রাগ ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার তাকানোর ভঙ্গিমাটা এমন ছিল যে তোমাকে আমি আলু ভর্তা বানিয়ে খেয়ে ফেলবো। আমি আবার সেই অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললাম “আমার কথা কি বিশ্বাস হচ্ছে না? পুরোটাই তো তোমাকে এখনও বলা হয়নি। আজহার ভাই এর বাসাই গিয়ে দেখি ভাবী বাসায় নেই। ভাবী গিয়েছে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে। আজহার ভাই এর সাথে চা খেতে খেতে দেখি সে হঠাৎ করে কান্না করছে। আমি বললাম কি ভাই কান্না করেন কেন? সে বলে বউকে মিস করি। আমি কি বলবো কিছু বুঝতে পারিনা। সে যে বউ পাগলা আমি জানতামই না। বউ ছাড়া থাকতে পারে না। কিন্তু বেচারার কাধে তো অফিসের অনেক দায়িত্ব। এই দায়িত্বের কথা ভেবে সে গ্রামে বউ এর সাথে যায় নাই। আর এই কান্না থামানোর শান্তনা দিতে দিতেই একটা রাত কেটে গেছে। একটা মানুষ এতো কান্না করতে পারে কিভাবে? এই যে উনার দুইটা চোখ দেখছো এই গুলা চোখ না, এই গুলা এক একট সমুদ্র। আমি কি জানতাম এই মাথা মোটাটা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মত কান্নাকাটি করবে? একটা রাত তোমার জন্য কত কষ্ট, তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে না দিলে সেটা কি উনি বুঝবে? বুঝবে নাতো, সে তো অফিসের দায়িত্ব ছাড়া কিছু বুঝে না” এই কথা বলে আমি আজহার ভাই এর দিকে তাকাই। আজহার ভাই বড় বড় চোখ নিয়ে তাকায়। কি হচ্ছে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। আজহার ভাই অবাক হয়ে বললো “তুই এই গুলা কি বলতেছিস?” আমি আজহার ভাইকে পুনরায় চোখ টিপ মেরে হাত দিয়ে বুঝাই পরে বুঝাই বলবো ভাই এখন চুপ যান। মায়িশা কোমড়ে দু হাত রেখে জোরে জোরেই আমাকে বললো “আমার সাথে মজা করো? আমাকে বাচ্চা মনে হয় তোমার?” এই কথা বলে আবার টানতে টানতে সিড়ি দিয়ে নামতে থাকে। আমি বললাম “মোবাইলটা নিয়ে আসি ছাড়ো না। ও আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকায়। তারপর হাতটা ছেড়ে দেয়। আমি আজহার ভাই এর বাসায় ঢুকতেই “আজহার ভাই বললো “তুই আমারে নিয়ে এই গুলা বললি ক্যান? এই আমি কি বউ পাগলা? আমার চোখ দুটো সমুদ্র?” আমি মোবাইলটা নিয়ে শার্টের কলার ঠিক ঠিক করতে করতে বললাম “পৃথিবীর সব পুরুষেরাই কম হোক আর বেশি হোক বউ পাগলা বুঝছো। কেন তুমি তোমার বউকে ভালোবাসো না? আচ্ছা এইটা বলো তোমার বাসায় যে আমি আছি মায়িশা কিভাবে জানলো?” আজহার ভাই একটু ইতস্তত হয়ে বললো “তুই ওয়াশরুমে ছিলি, তোর বউ ফোন করেছিল, আমি রিসিভ করেছিলাম।” আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। আমি আজহার ভাইকে বলি তোমাকে পরে সব কিছু বলবো। রিসিভ করেই ঝামেলা পাকায় দিছো। এমনিই কি বলছি তুমি মাথা মোটা?” এই কথা বলে আমি বের হয়ে যাই।
.
এই অবিরাম আকাশটার নিচে ফাকা রাস্তায় রিকশা করে প্রিয় মায়িশা আমাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে শায়েস্তা করার জন্য। আমি চুপ করে চারপাশটায় দেখতে লাগলাম। আমার সাথে কি ঘটবে আমি এর কিছুই জানি না। ঈদ মৌসুমে এই ফাকা রাস্তাঘাটে প্রিয় মানুষের সাথে রিকশায় চড়া একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু এই অনুভূতির বিন্দু মাত্র ছোয়াও এখন আমাকে কেন যেন স্পর্শ করছে না। আমার সমস্থ কিছু কোথায় যেন থমকে গিয়েছে। পৃথিবীর সব কোলাহল যেন ঝিম মেরে আছে। এই শহরের সকালের রৌদ্রের আলো এলোমেলো বাতাস মায়িশাকে ছুয়ে দেয়। সেই ছোয়ার মাঝে তার চুল উড়তে থাকে। আমি ওর দিকে মায়া মায়া আবেগে তাকাই। কেমন একটা গম্ভীর হয়ে চুপ করে আছে। সেই গম্ভীর চেহারার চোখের মাঝে আমি জল আসার আভাস লক্ষ্য করি। আমি কি বলবো বা আমার কি বলার উচিৎ অনুধাবন করে কিছুই বুঝতে পারি না। যেই আমি হাতের আঙ্গুলের নখ দাঁত দিয়ে কাটতে যাব তখনি মায়িশা আমার হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে সামনের দিকে আবার তাকিয়ে থাকে। যেন আমার সাথে তার কত অভিমান কিংবা রাগ। কিন্তু আমার ব্যাপারে তার যথেষ্ট খেয়াল আছে। অবশ্য রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দাঁত দিয়ে নখ কাটা নিয়েই যত ঝামেলা। আমি যখন কোন কিছু নিয়ে ভাবি, বা কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করি, বা কোন কিছু নিয়ে উত্তেজিত বা চিন্তিত থাকি তখন দাঁত দিয়ে নখ কাটতে থাকি। এই অভ্যাসটা আমার ছোট বেলা থেকেই। বিয়ের পর মায়িশা এটা নিয়ে আমাকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু কোন কাজ হয়নি। যখন কাজ হলো না তখন আমাকে থেরাপি দেওয়া শুরু করলো। বাসায় আমাকে একা টেলিভিশন দেখতে দিবে না। তার ধারনা টেলিভিশনে কোন মুভি বা নিউজ দেখার সময় আমি দাঁত দিয়ে নখ কাটি। তারপর অফিসে দু ঘন্টা পর পর ফোন দিয়ে বলবে “কি করছো? দেখো কাজ নিয়ে তাড়াহুড়া করবে না। যা করবে আস্তে ধীরে করবে। তারপর দুপুরে লাঞ্চের সময় বিডিও কল দিয়ে আমার হাতরে নখ চেক করবে। রাতে খাওয়ার সময় মাঝে মাঝে নিজ হাতে খাইয়ে দিবে। আমি তাকে একবার বলেছিলাম “ভাত খাওয়ার সময় কি কেউ দাঁত দিয়ে নখ কাটে আজব?” কিন্তু সে বলেছিল এই অভ্যাসটা যতদিন ছাড়তে না পারবে ততদিন আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিব। তোমার সমস্যা আছে?” আমি আর কিছু বলিনি। বাসায় আামার হাতের মাঝে হাত মৌজা পড়িয়ে দিত। এই একটা জিনিস আমার খুব বিরক্ত লাগতো। কিন্তু তার এইসব কাজ একটাও সফল হতো না। আমার জীবনটা কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তা আমি কিছুই উপলব্দি করতে পারছিলাম না। যেন একটা স্কুলের বাচ্চাদের মত জীবনটা আবার সাজাচ্ছি। সকালে কাধে ব্যাগ ধরিয়ে দাও। অফিসে যাও। অফিস থেকে এসে তার কথা মত চলো। কত সুন্দর জীবন। কিন্তু এসব কোন ব্যাপার ছিল না। নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিলাম। আসল ব্যাপার ছিল এই যে ফুটবল বিশ্বকাপ খেলা চলছে। আমার প্রিয় দলের যখন খেলা হচ্ছিল তখন আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম। আমি মায়িশারে বললাম “দেখো গরম লাগছে। মৌজার ভিতর হাত ঘামিয়ে গিয়েছে” সে কিছু না বলাতে আমি মৌজা খুলে ফেলি। এদিকে খেলা চলছে আর আমার মনের ভিতর একটা উত্তেজনা টান টান ভাব কে জিতবে? গোল হচ্ছে না কেন? উত্তেজিত হলে আমার হাত গুলো কেমন যেন ছটফট করতে থাকে। আমি বার বার মুখে হাত দিচ্ছিলাম মায়িশাও বার বার হাত সরিয়ে দিচ্ছিল। তারপর আমার দুই হাত তার দুই হাত দিয়ে ধরে নিজের কোলে রেখেছিল। কিন্তু এই ভাবে কি খেলা দেখা যায়? কেমন একটা বন্ধি কারাগারের মত বসবাস করছি। আমি কি ইচ্ছা করেই দাঁত দিয়ে নখ কাটি? খুব বিরক্তবোধ করেছিলাম। মাথাটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাগ করিনি। ঐ যে বিশিষ্ট লেখক বলে গিয়েছেন “মিচকা শয়তানরা রাগ করে না” ভারতের কোন নায়ক যেন মা আর বউ কে তুলনা করে বলেছিল “বউ হারালে বউ পাবি কিন্তু মা হারালে মা পাবি নারে পাগলা।” কিন্তু আমি রাগ আর বউ কে তুলনা করে বলি “রাগ চলে গেলে হাজার বার রাগ করা যাবে কিন্তু বউ চলে গেলে বউ পাওয়া যাবে নারে পাগলা” সিদ্ধান্ত নিলাম খেলা এইভাবে দেখলে চলবে না। ঐদিকে আজহার ভাই থেকে জানলাম উনার বউ বাড়িতে গিয়েছে ঈদ করতে। কি যেন ভেবে আমি আজহার ভাইকে বলেছিলাম “ভাই আমারও তো একই অবস্থা। আমার বউও বাড়িতে গিয়েছে। আমার বাড়িও খালি, আপনার বাড়িও খালি। আপনার বাসায় চলে আসি? একা একা থাকতে ভালো লাগে না। তবে আজ না, যেদিন আমাদের দুজনের দলের খেলা আছে। একসাথে দুজনে মিলে দেখলাম।” আজহার ভাই রাজিও হয়েছিল। কিন্তু আজহার ভাই জানতো না আমি এই গুলা লুকিয়েছিলাম। তাই পরশু মায়িশাকে বলেছিলাম ঢাকায় যাচ্ছি অফিসের একটা কাজে। মায়িশা প্রথমে ঘ্যানর ঘ্যানর করেছিল ঈদ না যেতেই মিটিং কিসের?” আমি ওরে বললাম “অফিস থেকে পাঠালে আমি কি কররো? আমি তো চাকরি করি তাই না? যার চাকরি করি তার কথা তো শুনতে হবে। চাকরি মানেই তো বুঝো চাকর।” সে আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিল। তার তাকানো যেন বলছিল “তুমি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছো জাহেদ” সব কিছু ঠিকই ছিল। রাতটাও পার করলাম খেলা দেখে। আমার নখ তেমন নেই বললেই চলে। সব কামড়িয়ে শেষ করে দিয়েছি গতকাল খেলা দেখে। কিন্তু এই আজহার ভাই যদি ফোনটা রিসিভ না করে কথা বলতো তাহলে এমনটা আর হতো না।
.
রিকশাটা বাসার সামনে এসে থামে। আমি ভাড়া দিতেই সে আবার আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাসার ভিতর নিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। আমার ভিতর একটা ভয় এসে জমা হয়। সে কোমড়ে শাড়ির আচল গুজতেই আমি বুঝলাম যার অর্থ আজকে তোরে খাইছিরে। কিন্তু তার চোখে জল আসার উপক্রম দিব্বি আমি দেখতে পাচ্ছি। সে আমার দিকে জল আাসার উপক্রমের মায়ামায়া চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। আমিও কিছু বলি না। তার চোখে কান্নার আভাস আর শরীরে রাগ মাখানো এই দুটোর মধ্যে আমি হঠাৎ করে যেন একটা আত্মপ্রশান্তির অনুভব করলাম। যে প্রশান্তিতে আমার এই বদ্ধ ঘরে নিরবতা এসে ভর করে। আমি কিছু বলে উঠার আগেই সে আমাকে খুব গম্ভীর হয়ে বললো “আমাকে কেন মিথ্যে বললে তুমি?” আমি চুপ করে থাকি। এমন মায়া আর অভিমান মাখানো কথায় আমার শরীরের সিড় ধারায় কিছু একটা বয়ে যায়। আমি মাথা নিচু করে তাকে ইতস্তত করে বললাম “কষ্ট পেয়েছো?” সে আমার এই কথার কোন প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললো “আমি কি তোমায় খুব জ্বালাতন করি? খুব বিরক্ত করি?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইশারা দিয়ে একটু কাছে গিয়ে ওর হাতটা ধরে বললাম “এমনটা কখনই না। আমি খুব দুঃখিত।” সে আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দু কদম পিছনে গিয়ে একটু জোড়েই বললো “তাহলে কেন মিথ্যে বললে? কেন আমার থেকে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো তোমার?” তার এমন শব্দে আমার আলোর ঘরে যেন আঁধার ঢোকার দৃশ্য চোখে ভাসে। আমি খুব শান্ত ভাবেই তাকে সব কিছু খুলে বললাম। তার সেই মায়ামায়া চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি মুছে দিতেই সে বললো “আমাকে ছুবে না তুমি। অনেক স্বার্থপর তুমি। শুধু নিজেরটা ভাবলে। আমার কি একা থাকতে ভয় লাগে নাহ? আর এই যে তোমার দাঁত দিয়ে নখ না কাটার জন্য এতো কিছু করলাম কেন করেছি? কেউ যখন তোমাকে এই বিষয়টা নিয়ে মজা করে আমার কি খারাপ লাগে না?” আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। কেন যেন নিজের গালে একটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করলো। আমার কি এমনটা না করলেও হতো না? আসলেই আমার এই দাঁত দিয়ে নখ কাটার বিষয়টা নিয়ে যখন কেউ কিছু বলে মায়িশার মুখটা খুব আচ্ছন্ন হয়ে যায়। বিয়ের পরে চাকরির কারনে আমি ওকে শহরে নিয়ে আসি। কিন্তু নতুন বিয়ে বলে কথা। বিয়ের পর আত্বীয়স্বজনরা দাওয়াত দেওয়ার আমেজটা লেগেই থাকে। তার ধারাবাহিকতায় তার বড় বোনের শ্বশুর বাড়িতে ঘুরে আসার জন্য বলেছিল। ওখানে গিয়ে একটা দিন কাটানোর পর ওর বড় বোন যখন আমার এই দাঁত দিয়ে নখ কাটা বিষয়টা দেখলো তখন তিনি বললো “এই তুমি তো দেখছি একটা খবিশ। দাঁত দিয়ে নখ কাটো কেন হ্যাঁ?” আমি একটা হাসি দিয়ে বলেছিলাম “না মানে আপা ছোট বেলার অভ্যাস ছাড়তে পারি না” আর এই দৃশ্যটা মায়িশা লক্ষ্য করেছিল। ও কাছে আসতেই মায়িশাকে দেখে বড় আপা বললো “মায়িশা তোর জামাই তো একটা খবিশ।” মায়িশা আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো “আপা স্যরি বলো ওকে।” আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। বড় আপা বললো “কেনরে?” মায়িশা চুল গুলা কানে গুজে বললো “স্যরি বলতে বলেছি বলো।” আপা চোখ কপালে তুলে বললো “কিন্তু কেন? তোর জামাইকে স্যরি বলবো কেন?” মায়িশা একটু রেগে বললো “এই জন্যই বলবে তুমি আমার স্বামীকে খবিশ বলেছো। তোমার সাহস কোথা থেকে আসে খবিশ বলার? তুমি স্যরি বলবে? তুমি স্যরি না বললে এখনি তোমার বাসা থেকে বের হয়ে যাব। বলবে তুমি স্যরি?” বড় আপা ঠিকি পরে আমাকে স্যরি বলেছিল। আমি মায়িশাকে বলেছিলাম “আহা বড় আপা মশকরা করে বলেছে আরকি। এমন না করলে কি হতো না?” সে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এরপর থেকেই বড় আপা আমার সাথে সব সময় হিসেব করে কথা বলে। মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজ খবর নিয়ে বলে “আমার বোনটাকে কি এমন তাবিজ করলা তুমি হ্যাঁ? তোমাকে কেউ কিছু বললে ও ছ্যাত করে ওঠে।” আমি বলি “আপা ভালোবাসা বুঝলেন ভালোবাসা।”
.
মায়িশার কাছে এমন মিথ্যা কথা বলা মোটেও উচিৎ হয়নি আমার। অনেকটা সময় অতিক্রম হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যার আবছায়া পার হয়ে রাত আসে। সে আমার সাথে কথা বলে না। আমি নির্বাক, অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ়
Comments
Post a Comment