অব্যক্ত ভালোবাসা

 

অব্যক্ত ভালোবাসা
অব্যক্ত ভালোবাসা

অব্যক্ত ভালোবাসা

লিখাঃ জান্নাতুল ফেরদৌস

রাত বারোটা মিলির চোখে ঘুম নেই। বারবার শুধু আবিরের মুখখানাই ভেসে উঠছে ওর মনে। এত বছর পর দেখা তাও এভাবে কখনো ভাবতেই পারেনি মিলি। মিলি কালকের কথা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছে না। নিয়তির খেলা বুঝি এমনই হয়। জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিলি বিছানা ছেড়ে উঠে বেলকনিতে দাড়ালো। শহরের রাত আর দিন বোঝা খুব দায় বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলোতে। সারারাত গাড়ির আওয়াজ আর রোড লাইটের আলোয় ভীষণ বিরক্ত লাগে কখনো কখনো মিলির তবে এই ক'বছরে অনেকখানি মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে।


আবির দু'টো ঘুমের ওষুধ খেয়েও যেন চোখের পাতা এক করতে পারছে না। মিলির সাথে আচমকা দেখা হওয়ায় আবিরও কিছুটা হতবাক। মিলি ঠিক আগের মতই আছে একটুও যেন বদলায়নি। সেই চোখ সেই চাহনি সেই রহস্যময় হাসি। উফফ! কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছে না মিলির ছবি অথচ এত বছর তো দিব্যি ভুলেই ছিলো। আসলেই কী ভুলে ছিলো নাকি ভোলার অভিনয় ছিলো নিজের সাথে! আবির চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে লাগলো।


বছর চারেক আগের কথা। মিলি আর আবির দু'জনেই খুব ভালো বন্ধু ছিলো আসলে বন্ধু বললে ভুল হবে বন্ধুর চেয়ে একটুখানি বোধহয় বেশিই ছিলো তবে ওরা কেউই কাউকে সেটা জানায়নি। নিজেদের একে অপরের প্রতি ভালো লাগার কথাটা মনেই রেখেছিলো। একজন সাহস করে বললে হয়তো আজ দু'জনে একই পথের সঙ্গী হতে পারতো। তবে দুজনের মাঝে এমন কিছু একটা ছিলো যা দ্বারা দু'জনেই খুব ভাল করে বুঝতো একে অপরের প্রতি ভালোলাগার টানটা কিন্তু  দু'জন ছিলো দু'মেরুর বাসিন্দা।


আবির ছিলো উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান আর মিলি ছিলো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেজো মেয়ে। অনেক কিছুতেই ওদের দু'জনার মিলতো না। আবিরের বন্ধুর সংখ্যা  খুবই সীমিত ছিলো। অন্যান্য বড়লোক বাপের ছেলেদের মতন টাকা উড়ানো, নেশায় আসক্ত কিংবা সারাদিন আড্ডাবাজি করার মত ছেলে আবির ছিলো না। ওদিকে মিলি ছিলো বন্ধু-বান্ধবে দারুণ আগ্রহী। সাহিত্য নিয়ে কিছুটা আগ্রহ থাকায় মিলি প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশ নিতো। তেমনই এক কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম দেখা হয় ওদের। মিলির কবিতা আবৃত্তিতে আবির প্রায় মুগ্ধ হয়ে যায়। তারপর টুকটাক খোঁজ নিয়ে পরিচয় হয়ে যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার মিলি আর আবির একই বিভাগের কিন্তু মিলি ছিলো এক ইয়ার জুনিয়র।


এভাবে সময় চলতে থাকে আর দিনে দিনে বাড়তে থাকে ওদের বন্ধুত্ব আর মনের অগোচরের ভালোবাসা। কে জানতো নিয়তি অন্য কিছু লিখে রেখেছিলো ওদের কপালে। আবির একদিন একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিল মিলির সাথে পরিচয়ও করিয়ে দেয়ার জন্য। মেয়েটি আবিরের খালাতো বোন ছিলো আর মেয়েটির মা ছোট বেলায় মারা যাওয়ায় আবিরের মাকেই মেয়েটি মা বলে ডাকত। ওদের দু'জনের মধ্যে মিলও ছিলো অনেক। মেয়েটি আবিরকে আগে থেকেই পছন্দ করতো আর আবিরের মা'ও বোনের মেয়েকে নিজের ছেলে বউ করে আনার স্বপ্ন দেখতো। মেয়েটি জানোতো এই কথা যে, সেই একদিন আবিরের বউ হবে কিন্তু আবির মাঝখানে মিলিকে বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু ভেবে ফেলেছে সেটা মেয়েটি জানতো না। 


মেয়েটির নাম ছিলো মেঘা। মেঘা কথায় কথায় আবিরকে জামাই বলে ডাকতো। আবিরও ফাজলামোর ছলেই নিতো এই ডাক তবে আবিরের ভুল ছিলো মিলির কথা মেঘাকে না জানানো। একদিন মেঘার সাথে হুট করেই মিলির দেখা হয়ে যায় সাথে আবিরের মা'ও ছিলো কিন্তু সেইদিনই মিলি পুরোটা জানতে পারে আর নিজের অজান্তেই সরে যায় আবিরের জীবন থেকে। মেঘাকে আবিরের মা মেয়ে এবং পুত্রবধূ দুই নজরেই দেখে। মিলি সেদিন ঠিক করে নিয়েছিলো তার জন্য আসলে আবির নয় আর উচ্চবিত্তদের সাথে মধ্যবিত্তদের যায় না। যদিও আবির আর ওর মাকে দেখে কখনোই উচ্চবিত্তের কোনো আহামরি বড়াই করার মত মনে হয়নি তবুও সেদিন বাস্তবতা মেনে হাসিমুখে আবিরের জীবন থেকে নিজের নামটা মুছে দিয়েছিলো মিলি।


মেঘা মেয়েটাও অনেক ভালো। আসলে সে ছোটোবেলাতেই ওর মাকে হারিয়েছিলো। তাই আবির আর তার মা'কে ঘিরেই মেঘার একটা জগৎ তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। মিলিকে সে অনেকবার বলেছে আবিরকে পছন্দ করার কথা আর হয়তো আবিরও মেঘাকেই ভালোবাসে তাই ভেবে মিলি নিজ থেকেই সরে এসেছিলো। এদিকে মিলির বাবার হঠাৎ হার্ট এ্যাটার্ক হওয়ায় মিলির বড় দুলাভাই আর চাচারা মিলির বিয়ে ঠিক করে ফেলে। মিলিও কোনো অমত করেনি। চুপচাপ বিয়েতে মত তো দিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু তার মনে কেবল আবিরই ছিলো। সব বন্ধুদের সাথে আবিরকেও বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিলো মিলি হাসি মুখে। আবিরের জীবন এর সবচেয়ে দুঃখের দিন ছিলো সেটা। আবিরও ভেবেছিল হয়তো মিলি তাকে শুধু বন্ধুই ভাবে তাই মনের কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলো। তারপর মিলির বিয়ে আর আবির উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছিল। ওদের যোগাযোগটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।


সব ভালোই চলছিলো কিন্তু গত রাতে ট্রেনে দেখা হয়ে গেল দু'জনার। মিলি গিয়েছিল বাবার বাড়িতে আর ফেরার পথেই ট্রেনে দেখা হয়ে যায় আবিরের সাথে। অনেক কথা হয় দু'জনার। আবির শেষমেশ ওর মায়ের কথাতেই বিয়ে করেছিলো মেঘাকে। অফিসের কাজ শেষে আবিরও ফিরছিলো একই ট্রেনে। এক সাথে কাটানো বন্ধুত্ব'র স্মৃতিমাখা মুহূর্তগুলো আর নিজেদের পরিবার নিয়ে কথা বলতে বলতেই যাত্রাটা শেষ হয়েছিলো দু'জনের।


আশ্চর্য হলেও এটাই সত্যি যে, এখনও কেউই জানে না, কেউই জানায়নি আজ অবধি একে অপরকে তাদের মনের অগোচরে লুকানো ভালোবাসার কথাটা। ওরা একে অপরের খুশির জন্য সরে এসেছিলো একে অপরের জীবন থেকে। তাই তো ভালোলাগা থেকে ওদের ভালোবাসার অনুভূতিটা আজও অব্যক্তই রয়ে গেল।

Comments

Popular posts from this blog

একজন পতিতার প্রেমের গল্প

What are the benefits of exercising in the morning?

Know the right time to exercise