ভালোবাসার বন্ধন

ভালোবাসার বন্ধন
বন্ধন

  • ভালোবাসার বন্ধন 

কুসুম হাড়ি থেকে পিঠা নামাচ্ছে। তাঁর পাশে বসা এগারো মাস বয়সের ছোট্ট মেয়েটা অস্পষ্ট স্বরে মা মা বলে কাঁদছে।বাচ্চা মেয়ে দুধের তৃষ্ণা পেয়েছে। কিন্তু কুসুম লোকজনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে তুলিকে দুধ খাওয়াতে পারছে না। মেয়েটা কেঁদেই চলছে। ওর কান্না দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। বড্ড মায়া লাগছে। আহারে এতিম মেয়েটা কীভাবে কাঁদছে! পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছে।জন্মের পরই বাবাকে হারিয়েছে। এইতো কমাস আগেই কুসুমের জামাইডা মইরা গেছে। প্লাস্টিক কম্পানিতে কাম করতো।সেদিন হুট করেই কম্পানিতে আগুন লেগে যায়।কুসুমের জামাই-সহ আরো কয়েকজন তখন কম্পানির ভিতরে কাজ করছিলো।বেচারারা বাঁচার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু রক্তরাঙা মৃত্যুক্ষয়ী অগ্নিকুণ্ডুলি থেকে বাঁচতে পারেনি। রাসায়নিক পদার্থের স্পর্শে আগুন মুহূর্তেই পুরো কম্পানিকে গ্রাস করে ফেলে।'


কুসুমের জামাই মইরা যাওনের পর কম্পানির মালিক ভর্তুকি হিশেবে তাকে এক লক্ষ টাকা সাহায্যদান করেছে।সেই টাকা কুসুম ছুঁয়েও দেখতে পারেনি।তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি সব টাকা ছিনিয়ে কনিয়েছে।তাকে একটা কানাকড়িও দেয়নি এবং সেই বাড়ি থেকে চলে আসতে বলেছে।কুসুম সেদিনই মেয়েকে নিয়ে ওই বাড়ি থেকে চলে এসেছে।স্বামী নেই তো স্বামীর বাড়িতে থাকার কোনো মানে হয়?চলে আসে বাপের বাড়িতে।কুসুমের বাপ অনেক আগেই মারা গেছে।আপন বলতে বড় দুইটা ভাই আর বৃদ্ধ মা আছে।আপাতত ভাইয়ের সংসারে গিয়ে উঠতে হবে।কিন্তু এখানেও কি তাঁর ঠাই হবে?ভাইয়ের সংসারে সে কি শান্তিতে থাকতে পারবে?ভাইদের সংসারের অবস্থা তেমন একটা ভালো না।সবসময় টানাপোড়ন লেগেই থাকে।খুবই আর্থিক সংকটে আছে।একদিকে ঘরে বৃদ্ধ মা আবার কুসুম চলে আসাতে ভাইদের কপালে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।কুসুমও সেটা বুঝতে পেরেছে।শত কষ্ট হলেও ভাইয়েরা হয়তো মুখে কিছু বলবে না,কিন্তু ভাবিদের মুখে কিছু আটকাবে না।তাঁরা এক থুয়ে বলবে না।তাই কুসুমও চাচ্ছে না ভাইদের সংসারে বসে বসে খেতে।কিন্তু সে কী করবে?আজকাল মেয়েদের কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই।


এখন হাড়কাপা শীত চলছে।কুঁয়াশা মোড়ানো শীতের সকালে গরম গরম পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা।কুসুমের পিঠার ব্যবসা বেশ ভালোই চলছে।সকাল বেলা কাস্টমারের ভীড় লেগে যায়।কুসুম দুইহাতে বানিয়ে কুলাতে পারে না।আরো দুইটা হাত যদি থাকতো কুসুমের জন্য ভালোই হতো।'


তুলি এখনো কেঁদেই চলেছে।চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে।কিছুতেই কান্না থামছে না।দুধ খাওয়া না পর্যন্ত থামবেও না।আমার খুব রাগ হচ্ছে কুসুমের ওপর।ধমক দিয়ে বললাম,'মেয়েটা কখন থেকে কাঁদছে শুনতে পাচ্ছিস না?আগে মেয়েকে দুধ খাইয়ে কান্না থামা তারপর পিঠা বেঁচবি।ধমক শুনে কুসুম আমার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালো।তারপর শান্ত গলায় বলল,'তোর বুঝি দরদ উতলাইয়া উঠছে!এতই যখন  দরদ তো তুই নিয়ে যা,দুধ খাওয়াই নিয়ে আয়।


আমি যদি দুধ দিতে পারতাম তাহলে আর তোকে বলতাম না।তোর কি মেয়েটার জন্য একটুও মায়া হয় না?


না, হয় না।আমার মনে কোনো মায়া মমতা নাই।এক আপদ মরছে আরেক আপদ রাইখা গেছে।সারাদিন শুধু কান্দে আর কান্দে।দুধ ছাড়া কিচ্ছু খায় না,শান্তিতে একটু ঘুমাও না।আমার হয়েছে যত জ্বালা।মাঝে মধ্যে মন চায় গলা টিপে মেরে ফেলে নইলে নিজে মইরা যাই।'


তুই কি পাগল হইয়া গেছোস? নিজের পেটের সন্তানরে কেউ আপদ বলে?দেখ,তোর জামাইয়ের হায়াত ছিলো না তাই আল্লাহ তারে নিয়ে গেছে।কপালের মাইর কিচ্ছু করার নাই।তাই বইলা তুই মাইয়াডার লগে এমন ব্যাবহার করবি?এটা তুই ঠিক করছিস না।'


তোর এতো দরদ কেন?তুই কেলা?যা এইখান থেকে,আর কোনোদিন আমার দোকানে আসবি না।তোর মতো কাস্টমারের আমার দরকার নাই।'

হুম,আর আমু না তোর দোকানে।'


যাবো না যাবো না বলেও প্রতিদিনই ছুটে যায়।পিঠার প্রতি আমার তেমন একটা লোভ নেই।শুধু তারে একবার দেখিতে।পিপাসু চোখগুলো শুধু চায় তারে দেখিতে।অনেক অনেক তৃষ্ণা এই দুটি চোখে।কুসুমরে আমার ছোটকাল থেকেই ভালোলাগতো।ওর চাল-চলন কথাবার্তা সবই আমার ভালোলাগতো।ভালোও বাসতাম কিন্তু কখনো বলতে পারিনি।আমি ছিলাম কিছুটা ভীরু প্রকৃতির।প্রেমিক হতে হলে সাহস লাগে। ভীরুরা কখনো প্রেমিক হতে পারে না।'


ভেবেছিলাম কুসুমরে একবারে বউ করে নিয়ে আসবো।কিন্তু সেটা আর হলো না।তার আগেই শুনলাম কুসুমের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।তারপর সামান্য একজন ভাংগাড়িওয়ালা হয়ে কুসুমের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে সাহস হয়নি।'

আমি ভাংগারি আর পুরোনো মালের ব্যবসা করি।সারাদিন ময়ালে ঘুরে ঘুরে পুরোনো জিনিসপাতি কিনি।ডেকে ডেকে বলি,এই বেঁচবেন নাকি ভাংগারি, পুরোনো বই,খাতা,প্লাস্টিক,লোহা,টিন,কাঁচের বোতল,প্লাস্টিকের বোতল,থাকলে তাড়াতাড়ি নিয়া আসেন।বুটও খাইতে পারবেন,চানাচুরও খাইতে পারবেন,আবার টাকাও নিতে পারবেন।'


প্রতিদিন ময়ালে বের হওয়ার আগে কুসুমের দোকানে পিঠা খেতে যাই।আর কুসুম প্রতিদিন আমার সাথে এভাবে ঝগড়া করে।মাঝে মধ্যে দৌড়ানিও দেয়।কুসুমের ব্যাবহার এরকম ছিলো না।আসলে জামাইডা মইরা যাওনে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।আর হওয়াটাই স্বাভাবিক। এরকম পরিস্থিতিতে থাকলে যেকারো মাথা নষ্ট হয়ে যাবে।কুসুমের কষ্ট দেখে আমার খুব খারাপ লাগে।ওর জন্য আমার প্ররাণডা কান্দে।'


আজ সারাদিন ময়ালে বের হইনি।মনডা ভীষণ খারাপ।কিচ্ছু ভাল্লাগছে না।আমার কী হয়েছে নিজেও জানি না।সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে এসে আম্মারে কইলাম, 'তোমার লগে কিছু কথা আছে।

কী কইবি কইয়া ফালা।'

আম্মা,কাশেম চাচার মাইয়া কুসুমরে তো তুমি চিনো?

হুঁ।কেন?

কয়েক মাস আগে ওর জামাইডা মইরা গেছে।এখন বাচ্চা মাইয়াডারে লইয়া খুব বিপদের মধ্যে আছে।

হুম,সবই জানি।কিন্তু কী করবি?

আমি চাই ওরে বিয়ে করতে।তোমার ঘরের বৌ করে আনতে।


আমার কথা শুনে আম্মা মনে হলো আকাশ থেকে পড়লো।বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

কী হলো আম্মা?কিছু তো বলো!

তুই বিয়ে করবি এটা তো খুবই আনন্দের বিষয়।কিন্তু বাবা,মাইয়াডা বিধবা তার ওপর একটা মেয়েও আছে।মাইয়া বিধবা এতে আমার কোনো আপত্তি ছিলো না।কিন্তু জানোস তো,পর কখনো আপন হয় না।পরের মাইয়া বাপ ডাকে না।'

এসব কুসংস্কারের ধার ধারি না।তুমি জানো না আম্মা,সেদিন কুসুমের মাইয়াডারে কোলে নিছিলাম তারপর আর কোল থেকে নামতে চায় না।কেঁদেটেদে একাকার করে ফেলছে।'

ছোট সময় পোলাপান এমনই করে বয়স হলো এসব থাকে না।'

এসব নিয়ে আমি ভাবি না।'

কিন্তু!

কিন্তু কী?ওরা আমার কাছে বিয়ে দিবে না?আমি পুরোনো মালের ব্যবসা করলেও ওদের থেকে কামাই কম করি না।ওদের থেকে আমার সংসার অনেক ভালো চলে।এখন তুমি রাজি কি-না সেটা বলো?

তুই যখন চাচ্ছিস আমি কি আর না করতে পারি?

এইতো আমার লক্ষ্ণী মা।'

আচ্ছা ঠিক আছে কাল আমি ওদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো।'

ভালোবাসার বন্ধন
বন্ধন

কুসুম বিছানার উপর বসে আছে।তাঁর পাশেই তুলি হাত পা ছড়িয়ে হা করে ঘুমাচ্ছে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে!যেন এক ঘুমন্ত পরী।আমি ধীরে ধীরে কুসুমের পাশে গিয়ে বসলাম।তারপর বললাম,সবই তো শুনেছিস,আমাকে বিয়ে করতে তোর কোনো আপত্তি আছে?কুসুম বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।ছেলেটা পাগল নাকি!সেই ছোটকাল থেকে তার পেছনে পড়ে আছে।তার বিয়ে হয়ে যাওয়াতে এখন পর্যন্ত বিয়ে করেনি।সে এখন বিধবা তার একটা মেয়েও আছে।আর এটা জেনেও তাকে বিয়ে করতে এসেছে।ছেলেটা আসলেই পাগল।পাগল নাহলে কেউ কাউকে এতোটা ভালোবাসতে পারে না।কুসুম আবার ভাবে,এমনতো নয় যে আলম তাকে করুণা করতে এসেছে,দয়া দেখাতে এসেছে।কুসুম ভেবে পাচ্ছে না কী করবে।

কুসুম চুপ করে বসে আছে কিছু বলছে না। আমি আরেকটু গা ঘেসে বসলাম। দেখ কুসুম, তুই বিধবা তোর একটা মেয়েও আছে এসব জেনেও আমি তোকে বিয়ে করতে এসেছি তাই বলে ভাবিস না, আমি তো করুণা করতে এসেছি, দয়া দেখাতে এসেছি। এসেছি ভালোবাসা নিয়ে,ভালোবাসা দিতে।তোর এতিম মেয়েটার দায়িত্ব নিতে।যদি রাজি থাকিস তাহলে হাত ধরে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ কর।

হুম,চল।'

গল্প: ভালোবাসার বন্ধন

~ সমাপ্ত

লেখাঃ আলম সরকার ধ্রুব

Comments

Popular posts from this blog

একজন পতিতার প্রেমের গল্প

What are the benefits of exercising in the morning?

Know the right time to exercise