তৃপ্তি

'মা ইফতারিতে কিছু বানাবা না?'

ছয় বছর বয়সী আলীর কথায় তার মা রহিমা বেশ চটে গিয়ে বললো, 'ভাত রাধুম। ভাত খাবি। আবার ইফতারি কিয়ের!'

আলীর মুখটা নিমিষেই চুপসে যেতে দেখে রহিমা আবার কড়া স্বরে বলে উঠলো, 'প্রথমদিন তো ইফতারি বানাইয়া খাওয়াইলাম। আবার শ্যাষদিন খাওয়ামু। প্রত্যেকদিন ইফতারি লাগবো ক্যা! ভাতই জুটনে কষ্ট আবার ইফতারি!'

আলী কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলো। রহিমা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো এখনো আলী কিছু মুখে তুলেনি। আজ সে রোজা তিনটে নয় একটাই রাখবে বলে পণ করেছে। রহিমা অবশ্য এখনো ভাবছে, খানিক বাদেই সে পণ বনে গেলো বলে। 

গলার স্বরটাকে শান্ত করে রহিমা বললো, 'আস্ত ডিম রাধুম তোর জন্য। একটু পর ভাত খাইস।'

আলী কোনো জবাব না দিয়ে হেঁটে চললো রাস্তার দিকে। রহিমা লেগে পড়লো পিঁয়াজ আর রসুনকুচি বাটাবাটির কাজে। খরতাপে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য সংগ্রহ করা রহিমার মন চাইলেও হিসেবের বাহিরে খরচা করতে পারে না। দিনমজুর স্বামীর স্বল্প আয়ে টেনেটুনে সংসার চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তার মাথায় থাকে বলেই মাথাটা তার একটু বেশি গরমই থাকে। যেখানে সে দিন কোনোরকমে চালিয়ে নিতে পারলেই বাঁচে, সেখানে ছেলের রোজ রোজ এসব ইফতারির বায়না তার কাছে বিরক্ততা।

মোড়ের মাথায় ভাজাপোড়ার দোকানটার বেশ নামডাক আছে পাড়ায়, লোকের মুখে, ফেসবুকের ফুড গ্রুপে। ইফতারির জন্য প্রতিদিন হরেক রকমের খাবার তৈরি হয় এই দোকানে। কাছ, দূর, এ পাড়া, ও পাড়া থেকে কম লোক আসে না এখানে! ভীড় জমে যায় বিকেল হওয়ার সাথে সাথে। তাই দুপুর হলেই খাবার তৈরির কাজ শুরু করে দেয় দোকানের লোকেরা। 

আলীও প্রতিদিন বিকেল হলে মোড়ের এই দোকানটাতে দূর থেকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকিয়ে দেখতে থাকে খাবারের রকমারিতা এবং মানুষের জটলা। একদিন সাহস করে দোকানের সামনে গিয়েছিলো কিন্তু দোকানদারের বকুনি খেয়ে আবার দৌড়ে ফেরত এসেছে। তারপর থেকে আর কোনোদিন দোকানের সামনে সে দাঁড়ায়নি। 

মায়ের কাছে একবার অবশ্য সে আবদার করেছিলো এখান থেকে ইফতারি কিনতে৷ কিন্তু রহিমা তাকে জানালো, এখানকার খাবার খেলে পেটে অসুখ হয়৷ 
আলী চটপট করে বলে উঠেছিলো, 'তাইলে এত লোক আসে ক্যান! পেটে অসুখ অয় না?'

রহিমাও কম যান না৷ ঝটপট বললো, 'তাগোর পেটে এইগুলা মানাইয়া গ্যাছে। এই জন্য কিছু অয় না। আমরা তো কোনোদিন এসব খাইনাই, আমরা খাইলে আমাগো পেটে অসুখ অইবো।'

আলী এরপর আর কখনো মায়ের কাছে আবদার করেনি। তারমানে এই নয় যে সে মায়ের কথা বিশ্বাস করেছে। আলী খুব করেই জানে যে তার মা তাকে মিথ্যা বলেছে। সে বিশ্বাস করে, এখানকার খাবারগুলো খুবই সুস্বাদু। এই জন্যই এত দাম, এত ভীড়, এত সুনাম।

আলী চুপচাপ তাকিয়ে আছে ক্রেতাদের কিনে নিয়ে যাওয়া প্যাকেটগুলোর দিকে আর প্রতিদিনের মতো মনে মনে কামনা করছে, কারো হাত থেকে একটা প্যাকেট যদি ভুল করে পড়ে রাস্তায় রয়ে যেতো। কিন্তু কখনোই আলীর এই চাওয়া পূরণ হয় না। সবাই খুব যত্ন সহকারে খাবারগুলো যার যার গন্তব্য অব্দি নিয়ে চলে যায়। আর আলী ফ্যাকাশে মুখে খালি হাতে বাড়ি ফেরে। 

আসরের আজান হয়েছে। মসজিদে নামাজ শেষ করে আলী আবার ভাজাপোড়ার দোকানের দিকে রওনা দিয়েছে। আগে এই মসজিদে প্রতিদিন ইফতারি দেওয়া হতো। আলী আর তার বাবা রোজ এখানেই ইফতারি করতো আবার মায়ের জন্য কিছু খাবার নিয়েও যেত। কিন্তু এবার কেউ ইফতারি দিচ্ছেন না৷ বাজারে সবকিছুর দাম আকাশ ছোঁয়া, সবাই নিজেদের খরচ সামলে উঠতেই হিমশিম খাচ্ছেন। সেখানে এতগুলো মানুষের ইফতার করানোটা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে উঠেছে বলে এবছর মসজিদে ইফতার কার্যক্রম বন্ধ আছে৷ 

আলী তাকিয়ে আছে লোকেদের দিকে। হঠাৎ খেয়াল করলো একটা খাবারের প্যাকেট একজনের হাত থেকে টুপ করে রাস্তায় পড়ে গেলো। আর সেই লোকটা টের না পেয়ে হাতে থাকা বাকি ব্যাগগুলো নিয়ে সামনে হেঁটে চলছে। আলী এক দৌড়ে গিয়ে প্যাকেটটা হাতে তুলে নিলো। তারপর কয়েক সেকেন্ড প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর দিলো দৌড়। বাড়ির দিকে নয়, ফেলে যাওয়া প্যাকেটের মালিকের দিকে। 

'আঙ্কেল, এইটা আপনার প্যাকেট। রাস্তায় পইড়া গেছিলো।' 
নানান ধরণের দাগ পড়া পুরাতন সাদা পাঞ্জাবী পাজামা পরহিত আলী হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলছিলো ত্রিশ পার করা বেকার যুবক নাফিজকে। যার পকেটের বর্তমান অবস্থা শূন্য৷ টিউশন শেষে কিছু জরুরী কেনাকাটা সেরে এখান থেকে ইফতার নিয়ে ফিরছিলো তার রুমের উদ্দেশ্যে। 

নাফিজ চুপ করে আলীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলো, 'কী নাম?'
ডাগরডাগর চোখে তাকিয়ে শুকনো ঠোঁটে আলী উত্তর দিলো, 'আলী।'

'রোজা রেখেছো?'

আলী মাথা ঝুঁকে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলে নাফিজ হেসে বললো, 'তিনটে?'

'আগে তিনটা রাখতাম। আজ একটাই রাখছি।'

নাফিজ আবার খানিকক্ষণ চুপ হয়ে রইলো। তারপর হেসে বললো, 'মাশা আল্লাহ! বাসায় কে কে আছে?'

'মা আর বাবা।'

নাফিজ আস্তে বললো, 'এই প্যাকেটটা বাসায় নিয়ে যাবে। মা আর বাবার সঙ্গে বসে ইফতার করবে। মা'কে বলবে, আজ আমি একটা ভালো কাজ করেছি তাই এটা একটা আঙ্কেল আমাকে উপহার দিয়েছে। ঠিক আছে?'

আলীর দু'চোখ চকচক করে উঠলো আনন্দে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না, অবশেষে সে সত্যিই একটা প্যাকেট বাড়িতে নিয়ে যাবে৷ আলী জিজ্ঞেস করলো, 'সত্যই নিয়া যাব?'

নাফিজ হেসে উঠলো, 'হুমম সত্যিই।'

আলী প্যাকেট হাতে দৌড় দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। নাফিজ হেঁটে চললো তার রুমের উদ্দেশ্যে। রুমে অপেক্ষা করছে তার এক বন্ধু। মেধাকে পিছনে ফেলে মামা চাচার জোরে যে এখন একজন উচ্চ বেতনের চাকুরীজীবি। 

রুমে প্রবেশ করতেই নাফিজের বন্ধুর আওয়াজ, 'অবশেষে এলি তুই! ভাগ্যিশ চাবিটা বাড়িওয়ালা দিয়েছিলো!'

নাফিজ আলতো হেসে বললো, 'তোমার তো ভাই কর্পোরেট লাইফ! আমার তো দিন আনি দিন খাই অবস্থা!'

'ওসব কথা ছাড়। ইফতারি খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলি কই তোর বিখ্যাত ইফতারি বের কর আজানের সময় বেশি বাকি নেই।'

'তোর জন্য কেনা ইফতারি আলী নামের একটা ছোট্ট ছেলে তার মা বাবার সঙ্গে আজ ভাগাভাগি করে খাবে।'

'দান করে এসেছিস?'

'উপহার দিয়েছি৷ পকেটে টাকা নেই বন্ধু। তাই এখন দু্ঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।'

'তোর স্বভাব আর গেলো না। পকেটে থাকে না টাকা, তবুও সে দাতা।'

নাফিজ হেসে বললো, 'তোর স্বভাব তো আর হলোই না। যখন টাকা ছিলো না, তখন টাকা হলে লোকের পাশে দাঁড়ানোর বুলি আওড়ানো সেই তুই আজ এত টাকার মালিক অথচ ........... '

নাফিজের বন্ধু চুপ হয়ে রইলো। নাফিজ রুমে থাকা খাবারগুলো ইফতারির জন্য প্রস্তুত করতে করতে বললো, 'আসলেই কী দান করতে অনেক বেশি টাকা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে, নাকি শুধু ইচ্ছের প্রয়োজন পড়ে? আমার মনে হয়, অভাবটা সবসময় টাকার হয় না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভাবটা আমাদের মানসিকতার হয়।'

আজান হচ্ছে। আলী বেশ মজা করে বাবা মায়ের সঙ্গে ইফতার করছে৷ এ পাশে নাফিজ সেসব ইফতারি না খেয়েই পুরো তৃপ্তিটা যেন পাচ্ছে। এই তৃপ্তিটা একদম আলাদা৷ সেরা কাতারের একটা তৃপ্তি। যে দেয়, সে পায়। 

গল্প: তৃপ্তি। 
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি৷

Comments

Popular posts from this blog

একজন পতিতার প্রেমের গল্প

What are the benefits of exercising in the morning?

Know the right time to exercise