কে বেশি ভালো?
আহমাদ। এবার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বের হয়েছে। অনেক ঘোরাঘুরি আর ধরাধরি করল; কিন্তু কোনো চাকরির বন্দোবস্ত হল না। একজন পরামর্শ দিল, অন্য শহরে গিয়ে দেখো।
আহমাদ তাই করল। দূরের এক শহরে চলে গেল। যাওয়ার পথে, গাড়িতে কথায় কথায় এক যুবকের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। যুবকের নাম খালিদ। খালিদ বড় লোকের ছেলে। নিজেও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। নিজ থেকে প্রস্তাব দিল,
-তুমিও আমাদের কোম্পানিতে যোগ দাও।
আহমাদ কোনোরকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই রাজি হয়ে গেল। দুজনে মিলে কোম্পানিটা আবার নতুন করে দাঁড় করাল। আহমাদ কারিগরি দিকটা দেখাশোনা করে। খালিদ মার্কেটিংয়ের দিকটা।
ব্যবসা দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠল। বিভিন্ন শহরে শাখা খোলা হল।
একদিন আহমাদ দেখল, খালিদের টেবিলের ওপর একটা ছবি পড়ে আছে। এক অনিন্দ্য সুন্দর মেয়ের ছবি। ছবি দেখে সে মুগ্ধ হল। আহমাদ অবাক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে নির্ণিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বিষয়টা খালিদের দৃষ্টি এড়াল না। আহমাদ শেষে আর থাকতে না পেরে প্রশ্ন করল:
- এটা কার ছবি?
- এটা আমার বাগদত্তার ছবি। তার সঙ্গে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। কেন, তোমার কি ছবিটা পছন্দ হয়েছে?
-হাঁ, সুন্দর তো সবারই পছন্দ হবে।
-তুমি সুযোগ পেলে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাও?
-এমন হীরের টুকরো মেয়ে পেলে কেউ অমত করে?
-ঠিক আছে। আমি এই মেয়েকে বিয়ে করব না। তোমার জন্য ছেড়ে দিলাম।
-না না, তা কী করে হয়! তোমার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সেখানে আমিইবা উটকো হয়ে নাক গলাবো কেন?
মেয়েটার সঙ্গে আহমাদের বিয়ে হল। কিছুদিন পর আহমাদের ইচ্ছা হল, নিজ শহরে চলে যাবে। বউ-বাচ্চা নিয়ে মা-বাবা, ভাই-বোনদের সঙ্গে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। কোম্পানির আয়-ব্যয় হিসাব করে আহমাদ তার প্রাপ্য বুঝে নিয়ে চলে এল। নিজ শহরে এসে ব্যবসা শুরু করল। আস্তে আস্তে তার ব্যবসা বড় হতে লাগল।
ওদিকে কী এক সমস্যার কারণে দিন দিন খালিদের ব্যবসায় মন্দা পড়তে লাগল। অনেক দিনের পুরনো এক মামলায় হেরে গিয়ে, পুঁজিপাতি সব খুইয়ে, স্বর্বস্বান্ত হয়ে পথে নেমে আসতে হল। এখন সে পথের ফকির।
একদিন আহমাদ ব্যবসার কাজে আগের শহরে এল। পথিমধ্যে দেখল, খালিদ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। জামাকাপড় ময়লা আর জীর্ণ। খালিদও দেখতে পেল আহমাদকে; কিন্তু আহমাদ দেখেও না দেখার ভান করে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। খালিদ মনে বড় ব্যথা পেল; কিন্তু কিছুই করার নেই।
এভাবে দিন চলতে লাগল। একদিন খালিদের সঙ্গে এক বৃদ্ধ লোকের দেখা। বৃদ্ধ লোকটি তার দুরবস্থা দেখে দয়ার্দ্র হল। সঙ্গে করে খালিদকে বাড়িতে নিয়ে এল। ভালো খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করল। থাকার জায়গা করে দিল। একটা চাকরিও জুটিয়ে দিল। পাশাপাশি একটা ব্যবসা ধরিয়ে দিল। আস্তে আস্তে খালিদের অবস্থাও ফিরে এল। একদিন বৃদ্ধ লোকটি বললেন,
– বাবা! তোমার কাজকর্ম দেখে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি তোমার পূর্বের ইতিহাসও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, তুমি বড় ঘরের ছেলে। আমার একটা মেয়ে আছে। আপত্তি না থাকলে তোমার কাছে বিয়ে দিতে চাই।
বিয়ে ঠিকঠাক। বিরাট আয়োজন করা হল। অনুষ্ঠানে ছোটরা বিয়ের গান গাইছে। এমন সময় আহমাদ স্ত্রীসহ বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রবেশ করল। খালিদ অবাক হল। তার রাগও হল। এত বড় নিমকহারামির পর এ লোক আবার এখানে আসে কী করে? আমি তো তাকে দাওয়াতও দিইনি!
খালিদ হনহন করে মঞ্চে গেল। মাইক্রোফোন নিয়ে সবাইকে চুপ করতে অনুরোধ জানাল। আগপিছ না ভেবে ঝোঁকের বশে বলল, 'আমি আমার বন্ধুকে স্বাগত জানাচ্ছি, যাকে আমি বিপদে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তার দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছিলাম; কিন্তু আমাকে নিঃস্ব অবস্থায় দেখে সে রাস্তা বদল করে অন্যপথ ধরেছিল। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করেছিল।
আমি আমার এমন বন্ধুকে স্বাগত জানাচ্ছি, আমার বাগদত্তা হবু স্ত্রীকে পর্যন্ত যাকে আমি দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এ বন্ধু আমার অসহায়ত্বের দিনে আমার দিকে ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি।
এসব বলতে বলতে তার গলা বুজে এল। কান্নার আবেগে তার গলা আটকে গেল। এবার আহমাদ এগিয়ে এল। মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিল। বলল, 'দুঃখিত বন্ধু! আমি তোমাকে দেখে রাস্তা বদল করেছিলাম। কারণ, আমাকে ধনী আর তোমাকে দরিদ্র আর নিঃস্ব দেখতে তোমার ভালো লাগবে না, এটা ভেবে। তোমার অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে ভেবেই আমি এমনটা করেছিলাম।
দুঃখিত বন্ধু! আমি সরাসরি সাহায্য করতে পারিনি। কারণ এ অবস্থায় সাহায্য করলে তোমার কাছে দান বা অনুগ্রহ বলে মনে হতে পারে। তাই আমার পিতাকে পাঠিয়েছিলাম তোমাকে সাহায্য করার জন্য।
দুঃখিত বন্ধু! আমি তোমার হবু বাগদত্তাকে বাগিয়ে নিয়েছি। কিন্তু জ্ঞানে-গরিমায় অত্যন্ত চৌকশ আমার ছোটবোনকে তোমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। খালিদ এসব শুনে অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
পুনশ্চঃ
খালিদ ও আহমাদ উভয়েই অত্যন্ত ভালো মানুষ। মহৎ মানুষ। এখন প্রশ্ন হল, দুজনেই মধ্যে কে বেশি ভালো?
[গল্পটি শাইখ Atik Ullah হাফিযাহুল্লাহ'র লিখিত "জীবনের বিন্দু বিন্দু গল্প" বই থেকে নেয়া।]
Comments
Post a Comment